Wednesday, May 7, 2008

ফরাসী দর্শনের অ্যাডভেন্চার

ফরাসী দর্শনের অ্যাডভেন্চার

অ্যালান বাদিউ

চলুন সাম্প্রতিক সময়ের ফরাসী দর্শনের উপর প্রতিফলনগুলি আমরা শুরু করি একটা প্যারাডক্সের মাধ্যমে: যা একই সময়ে সবচেয়ে বৈশ্বিক এবং সবচেয়ে নির্দিষ্ট। হেগেল এটাকে বলেন ‘সুনির্দিষ্ট বৈশ্বিক’ (‘concrete universal’), যার সংশ্লেষণ হচ্ছে পুরোপুরিভাবে বৈশ্বিক, যা সবকিছুর সাথেই যুক্ত, যার একটা নির্দিষ্ট সময় এবং স্থান আছে। দর্শন একটা ভালো উদাহারণ। পুরোপুরিভাবে বৈশ্বিক, এটা নিজেকে সবার সাথে পরিচিত করে, কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই; কিন্তু দর্শনের মধ্যেই ক্ষমতাশালী সাংস্কৃতিক এবং জাতিগত বিষয়গুলি বিরাজ করে। এগুলিকে আমরা বলতে পারি, স্থান (স্পেস) এবং সময়ের মধ্যে দর্শনের মুর্হূতগুলি। এভাবে দর্শন হচ্ছে যুক্তির একটা বৈশ্বিক ইচ্ছা এবং একইসাথে এমন একটা বিষয় যা নিজেকে প্রকাশ করে সম্পূর্ণভাবে নির্দিষ্ট মুহূর্তগুলির মধ্যে। চলুন আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং পরিচিত বিশেষ দুইটা দার্শনিক ঘটনাগুলির উদাহারণ নিই। প্রথমত, ক্লাসিক্যাল গ্রীসের দর্শন, যা প্যারামেনডস (Parmenides) এবং এরিষ্টটল এর মধ্যে ছিল, খ্রীষ্টপূর্ব ৫ম থেকে ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত: যা ছিল একটা উঁচুমানের উদ্ভাবন, ভিত্তি তৈরীর সময়, শেষ পর্যন্ত খুবই স্বল্পস্থায়ী। দ্বিতীয়ত, জার্মান আইডিলিয়াজম কান্ট এবং হেগেলের মধ্যে, ফিখটে (Fichte) এবং শিলিং (Schelling) এর মধ্যে দিয়ে: আরেকটা ব্যতিক্রমী দার্শনিক মুর্হূত, আঠারো শতকের শেষদিক থেকে উনিশ শতকের প্রথম পর্যন্ত, তীব্রভাবে সৃজনশীল এবং সন্নিবেশিত হয়েছিল আরো কম সময়ের মধ্যে। আমি প্রস্তাব করছি সর্মথনের জন্য আরো জাতীয় এবং ঐতিহাসিক তত্ত্বকে: সেখানে ছিল - অথবা সেখানে আছে, যেখানে আমি নিজেকে রাখি, তার উপর নির্ভর করে - বিশ শতকের শেষভাগে একটা ফরাসী দার্শনিক আন্দোলন, toute proportion gardée, যা উদাহারণ হিসাবে ক্ল্যাসিক্যাল গ্রীস এবং আলোকপ্রাপ্ত জার্মানের সাথে তুলনার মতো।

সার্ত্রের মূল কাজ বিয়িং এন্ড নাথিংনেস বের হয় ১৯৪৩ সালে এবং দেল্যুজের শেষ লেখা হোয়াট ইজ ফিলসফি? বের হয় ১৯৯০ এর প্রথম দিকে। এই দুইজনের মধ্যে যে ফরাসী দর্শন তৈরী হয়েছে, এবং যা অর্ন্তভুক্ত করে বের্চাড, মারিউ-পন্টি, লেভি-ত্রস, আলথুসার, ফুকো, দেরিদা এবং লাঁকা, অবশ্যই সার্ত্রে এবং দেল্যুজ - এবং আমিও, হয়তো। হয়তো সময় বলে দেবে; তারপরও যদি এমন একটা ফরাসী দার্শনিক মুর্হূত থেকে থাকে, আমার অবস্থানটা হয়তো হবে এর শেষ প্রতিনিধি হিসাবে। এটাই এই কাজের শরীরের সমগ্রতা, যা সার্ত্রের ভিত্তি ভেঙ্গে দেয়া অংশগ্রহণ এবং দেল্যুজের শেষ কাজগুলির মধ্যে অবস্থিত, যাকে এখানে বলার চেষ্টা হয়েছে ‘সাম্প্রতিক ফরাসী দর্শন’ হিসাবে। আমি যুক্তি দেখাবো যে, এটা একটা নতুন দার্শনিক সৃজনশীলতার মুর্হূত গঠন করেছে, বিশিষ্ট এবং বৈশ্বিক। সমস্যাটা হচ্ছে এই প্রচেষ্টাটাকে চিহ্নিত করা। ফ্রান্সে কী হয়েছিল, দর্শনে, ১৯৪০ থেকে বিশ শতকের শেষদিক পর্যন্ত? কী হয়েছিল উপরের এই দশটা বা এরকম নামগুলিকে ঘিরে? এটা কী যাকে আমরা বলি অস্তিত্ববাদ, সংগঠনবাদ, বিণির্মাণ? সেখানে কী একটা ঐতিহাসিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কোন ঐক্য ছিল, সেই মুর্হূতে? যদি থাকে, তাহলে সেটা কী রকম?

আমি এসব সমস্যাগুলির দিকে তাকাবো চারটা ভিন্ন দিক থেকে। প্রথমত, শিকড়গুলি: কোত্থেকে এই মুর্হূতটা এসেছে, এর পূর্ববর্তী ঘটনাগুলি কী, এর জন্মটা কী ছিল? তারপর, কী প্রধান দার্শনিক ক্রিয়াপদ্ধতিগুলি সে গ্রহণ করেছিল? তৃতীয়ত, এই দার্শনিকদের মূল প্রশ্ন যা সাহিত্যের সাথে সর্ম্পকিত, এবং এই ক্রমের এর মধ্যে সাহিত্য এবং দর্শনের আরো সাধারণ যোগসূত্র। আর সবশেষে, সমস্ত আলোচনার ভিতরে দর্শন এবং মনোবিশ্লেষণের স্থির আলোচনা। শিকড়গুলি, ক্রিয়াপদ্ধতিগুলি, শৈলী এবং সাহিত্য, মনোবিশ্লেষণ: এই চারটি উপায়, যার ভিতর দিয়ে আমি সাম্প্রতিক ফরাসী দর্শনকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি।

ধারণা এবং অর্ন্তবর্তী জীবন

এই মুর্হূতটার দার্শনিক শিকড়গুলি সর্ম্পকে চিন্তা করতে গেলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে সেই মৌলিক বিভেদটাতে যা বিশ শতকের প্রথমদিকে ফরাসী দর্শনের ভিতরে ঘটেছিল, দুটি প্রতিতুলনার বর্তমানের অভ্যুদয়ের সাথে। ১৯১১ সালে, র্বাগসঁ অক্সর্ফোডে দুটি জনপ্রিয় ভাষণ দেন, যা তার
La pensée et le mouvement সংগ্রহতে প্রকাশ করা হয়। ১৯১২ সালে, অন্যদিক থেকে - বার্নশেভঁ Les étapes de la philosophie mathématique প্রকাশ করেন। সেই মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে, এই ব্যবধানগুলি দুটি সম্পূর্ন ভিন্ন পরিস্থিতির প্রত্যয়ন করে। র্বাগসঁ এ আমরা যেটা পাই, তাকে আমরা বলতে পারি একটা জরুরী অর্ন্তবর্তী দর্শন, হওয়া এবং হয়ে উঠার স্বরূপের উপর একটা থিসিস; জীবন এবং পরিবর্তনের একটা দর্শন। এই পরিস্থিতিটা পুরো বিশ শতক ধরে বজায় থাকবে, দেল্যুজ পর্যন্ত এবং তিনিও। বার্নশেভঁ এর কাজে, আমরা পাই গাণিতিক ধারণার উপর নির্ভরশীল একটা দর্শন: চিন্তা এবং প্রতীকের একটা দার্শনিক রূপায়নের সম্ভাবনা, যা আগেরটার মতোই পুরো শতাব্দী ধরে চলেছিল, সবচেয়ে নির্দিষ্ট করে বললে লেভি-ত্রস্ত, আলথুসার এবং লাঁকা।

তাহলে, এই শতাব্দীর শুরু থেকে ফরাসী দর্শন একটা বিভেদ এবং দ্বান্দ্বিক চরিত্রকে তুলে ধরে। একদিক দিয়ে, জীবনের একটা দর্শন; অন্যদিক দিয়ে ধারণার একটা দর্শন। জীবন এবং ধারণার মধ্যে এই বির্তকটা যে সময়টা আসবে তার পুরোটার কেন্দ্রে তা থাকবে। এরকম কোন আলোচনায় বাজিটা হচ্ছে বিষয় (সাবজেক্ট) হিসাবে মানুষ এর প্রশ্নটা, এখানে এই দুই ধরণের পরিস্থিতিই একই জায়গায় আসে। একই সাথে একটা জীবন্ত প্রাণীসত্তা এবং ধারণাগুলির একটা উদ্ভাবক হিসাবে বিষয়টাকে জেরা করা হয়েছে দুইদিক থেকেই - তার অর্ন্তবর্র্তীতা, পশু, দেহযন্ত্রের জীবন এবং তার চিন্তা, তার উদ্ভাবনের ক্ষমতা ও বিমূর্তায়নের সাপেক্ষে। দেহ এবং চিন্তা, অথবা জীবন এবং ধারণা’র মধ্যে যে এই সর্ম্পকগুলি তৈরী হয়েছে বিষয় এর প্রশ্নটাকে ঘিরে, তারা এভাবে বিশ শতকের ফরাসী দর্শনের পুরো প্রক্রিয়াটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে, র্বাগসঁ এবং বার্নশেভ এর প্রাথমিক বৈপরীত্য থেকে। কান্টের দর্শনের রূপকের একটা যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে ছড়িয়ে দিয়ে সেখানে আমরা সবাই কম বেশি পরিশ্রান্ত যোদ্ধা: বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে, যুদ্ধের জায়গাগুলি আবিশ্যিকভাবে তৈরী হয়েছে সাবজেক্ট এর প্রশ্নটাকে ঘিরে। তাই, আলথুসার ইতিহাসকে সংজ্ঞায়িত করেছেন সাবজেক্ট বাদ দিয়ে, এবং সাবজেক্টকে দেখেছেন একটা আদর্শগত ক্যাটাগরি হিসাবে; দেরিদা হাইডেগারকে ইন্টারপ্রেট করতে গিয়ে সাবজেক্টকে দেখেছেন অধিবিদ্যার একটা ক্যাটাগরি হিসাবে; লাঁকা সাবজেক্ট এর একটা ধারণা সৃষ্টি করেছেন; সার্ত্র বা মারলাউ-পন্টি, অবশ্যই, সাবজেক্ট এর জন্য একটা সন্দেহাতীত কেন্দ্রীয় ভূমিকা নির্দিষ্ট করেছেন। তাই ফরাসী দর্শনের মুর্হূতটার প্রথম সংজ্ঞাটা হতে পারে হিউম্যান সাবজেক্ট এর দ্বন্দ্বটা, যেহেতু এই দ্বন্দ্বের বাজিতে মূল বিষয়টা হচ্ছে জীবন এবং ধারণার মধ্যে সর্ম্পকটা।

আমরা অবশ্যই, জিজ্ঞাসাটাকে আরো দূর পর্যন্ত পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারি এবং ফরাসী দর্শনের ভাগটাকে বর্ণনা করতে পারি কার্তেজান ঐতিহ্যের একটা ভাগ হিসাবে। একভাবে দেখলে, যুদ্ধ-পরবর্তী দার্শনিক মুহূর্তটাকে পড়া যেতে পারে দের্কাতের ধারণাগুলি (
ideas) এবং অর্থের (significance) মহাকাব্যিক আলোচনার প্রেক্ষিতে, সাবজেক্ট এর ক্যাটাগরির দার্শনিক আবিষ্কর্তা হিসাবে। দের্কাত পশু-যন্ত্রের শারীরিক শরীর (physical body—of the animal-machine) এবং শুদ্ধ প্রতিফলন - উভয়েরই তাত্ত্বিক ছিলেন। তিনি তাই দুই বিষয়েই সচেতন ছিলেন - ফেনোমেনার ফিজিক্স এবং সাবজেক্টের অধিবিদ্যা বিষয়ে। সাম্প্রতিক সব মহান দার্শনিকরাই দের্কাতের বিষয়ে লিখেছেন: লাঁকাঁ আসলে দের্কাতে ফিরে যাবার আহ্ববানই জানিয়েছেন, সার্ত্র কার্তেজান (Cartesian) স্বাধীনতার উপর একটা মনে রাখার মতো টেক্সট লিখেছেন, দেল্যুজ ছিলেন কৃপাহীনভাবে বিদ্বেষী। সংক্ষেপে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যতজন ফরাসী দার্শনিক আছেন, ততজন দের্কাত আছেন। আবার, এই মূল জায়গাটা ফরাসী দার্শনিক মুহূর্তের একটা প্রথম সংজ্ঞাকে প্রকাশ করে যে, এটা সাবজেক্ট এর প্রশ্নের ক্ষেত্রে একটা ধারণাগত যুদ্ধক্ষেত্র।

চারটা ধারা

পরবর্তীতে, সব চিন্তাবিদদের বুদ্ধিবৃত্তিক অপারেশন এর কমন জায়গাটাকে চিহ্নিত করা। আমি চারটা প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করছি, যা এই মুহূর্তের দর্শন চর্চার স্বরূপটাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারবে; সবগুলিই, একটা দিক থেকে দেখতে গেলে, পদ্ধতিগত বিষয়। প্রথম ধারাটা হচ্ছে একটা জার্মান ধারা - অথবা জার্মান দার্শনিকদের উপর একটা ফরাসী ধারা। সাম্প্রতিক সমস্ত ফরাসী দর্শন, বাস্তবেও, জার্মান ঐতিহ্যের উপর একটা আলোচনা। এর প্রাথমিক গঠনের পর্যায়টা হচ্ছে, হেগেলের উপর কজোভঁ (
Kojève’s seminars on Hegel) এর সেমিনারগুলি, যাতে লাঁকাঁ ছিলেন এবং এটা লেভি-ত্রস্তঁকেও প্রভাবিত করেছিল, এবং ১৯৩০ ও ৪০ এ হুর্সাল এবং হাইডেগারের কাজের মধ্যে দিয়ে ফেনোমেনোলজি’র (phenomenology) এর উদ্ভাবন। সার্ত্রের ক্ষেত্রে, তিনি তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে পরিবর্তন করেছিলেন, বার্লিনে কিছুদিন থাকার সময়, এসব লেখকদের মূল লেখা পাঠ করার পর। দেরিদাকে সম্ভবত বলা যেতে পারে, জার্মান চিন্তার একটা পুরোপুরি মূল ব্যাখ্যাদাতা হিসাবে সর্বপ্রথম এবং সর্বপ্রধান। ফুকো এবং দেল্যুজ এর ক্ষেত্রে, নিটশে একটা মৌলিক রেফারেন্স।

ফরাসী দার্শনিকরা হেগেল, নিটশে, হুর্সাল এবং হাইডেগারের কাজের মধ্যে দিয়ে জার্মানীতে কিছু একটা খুঁজতে গিয়েছিলেন। তারা এর ভিতর কী খুঁজছিলেন? এক কথায় বলা যায়: ধারণা এবং অস্তিত্বের মধ্যে একটা নতুন সর্ম্পক। এই খোঁজ যে অনেকগুলি নাম ধারণ করেছিল - বিনির্মাণবাদ, অস্তিত্ববাদ,
hermeneutics - তার পিছনে একটাই সাধারণ উদ্দেশ্য ছিল: এই সর্ম্পকটাকে পরিবর্তিত করা বা স্থানচ্যুত করা। চিন্তার অস্তিত্বগত পরিবর্তনটা, চিন্তার তার জীবন্ত আন্তভূমির সাথে সর্ম্পকটা ছিল ফরাসী চিন্তাবিদদের আগ্রহী হবার জায়গা, যা তাদের নিজস্ব ঐহিত্যেরও মূল জায়গা। তাই, এই ‘জার্মান ধারা’টা ধারণা থেকে অস্তিত্বের সর্ম্পকটাকে যাচাই করার নতুন পথগুলির সন্ধান, জার্মান দার্শনিক ঐতিহ্যগুলিকে আশ্রয় করার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে, ফরাসী দর্শনের যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে অনুদিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে, বরং জার্মান দর্শন একটা সর্ম্পূণ নতুন একটা বিষয়ে পরিবর্তিত হয়েছে । এই প্রথম ক্রিয়াপদ্ধতিটা হচ্ছে তাই জার্মান দর্শনের একটা কার্যকর ফরাসী আত্মীকরন।

দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটা, কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, যা বিজ্ঞান সর্ম্পকে সচেতনতা। ফরাসী দার্শনিকরা বিজ্ঞানকে জোরপূর্বকভাবে দেখতে চেয়েছেন, বিশিষ্টভাবে দর্শনের জ্ঞানের এলাকা থেকে, একটা উৎপাদনশীলতার প্রক্রিয়া বা একটা ক্রিয়েটিভ কাজ হিসাবে, একটা অবজেক্ট হিসাবে বা একটা অবধারণ হিসাবে না, এটা জ্ঞানের রাজ্য থেকে অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। তারা বিজ্ঞানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন উদ্ভাবনের মডেলগুলি এবং রুপান্তরগুলি সর্ম্পকে, যা তাকে উৎকীর্ণ করবে একটা সৃজনশীল চিন্তার প্রাকটিস হিসাবে, যা শৈল্পিক কাজের সাথে তুলনাযোগ্য, অন্য একটা সংগঠনের প্রকাশযোগ্য কোন ফেনোমেনার চাইতে। বিজ্ঞানকে এভাবে জ্ঞানের জায়গা থেকে সৃজনশীলতার জায়গাতে স্থানান্তরটা এবং শেষ পর্যন্ত তাকে শিল্প’র কাছে নিয়ে আসাটা দেল্যুজের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি সবচেয়ে সূক্ষ এবং সাবলীলভাবে বৈজ্ঞানিক এবং শৈল্পিক সৃজনশীলতার মধ্যে তুলনাটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু এটা তার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে, ফরাসী দর্শনের একটা কনস্টিটিটিভ প্রক্রিয়া হিসাবে।

তৃতীয় প্রক্রিয়াটা হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়টা। এই সময়ের দার্শনিকরা সবাই রাজনীতির প্রশ্নের সাথে দর্শনের যোগসূত্রকে গভীরভাবে দেখেছেন। সার্ত্র, মারলাউ-পন্টি, ফুকো, আলথুসার এবং দেল্যুজ ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী; যেহেতু তারা জার্মান দর্শনকে দেখতে গিয়েছিলেন ধারণা এবং অস্তিত্বের প্রতি একটা তাজা দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে, তাই তারা রাজনীতিকে দেখেছেন ধারণা এবং ক্রিয়ার মধ্যে একটা নতুন সর্ম্পক হিসাবে - বিশেষ করে, সমষ্টিগত কাজ হিসাবে। দর্শনকে রাজনৈতিক অবস্থার সাথে জড়িত করার মূল বাসনাটা ধারণা এবং কাজ এর মধ্যে সর্ম্পকটাকে পরিবর্তিত করেছে।

চতুর্থ প্রক্রিয়াটা হচ্ছে দর্শনের আধুনিকীকরণের বিষয়, একদিক দিয়ে যা সরকারী প্রশাসনের পারস্পরিক ভন্ডামি থেকে সর্ম্পূন ভিন্ন। ফরাসী দার্শনিকরা আধুনিকতার প্রতি তাদের প্রগাঢ় আর্কষণ প্রকাশ করেছেন। তারা সাম্প্রতিক শৈল্পিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উন্নতিগুলিকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। নন-ফিগারেটিভ চিত্রকলা, নতুন সঙ্গীত এবং থিয়েটার, গোয়েন্দা উপন্যাস, জ্যাজ এবং সিনেমা’র প্রতি দার্শনিকরা তাদের প্রচন্ড আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাদের একটা চেষ্টা ছিল দর্শনকে আধুনিক বিশ্বের প্রবল প্রকাশগুলির সাথে নিয়ে আসা। যৌনতা এবং নতুন জীবন-যাপনের প্রতিও তারা তীক্ষ মনোযোগ দিয়েছেন। এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে দর্শন ধারণাটা এবং নির্মিতিগুলির উৎপাদনের মধ্যে একটা নতুন সর্ম্পককে খুঁজছে। আধুনিকতা তাই অন্বেষণের জন্য একটা নতুন পথ যেখানে দর্শন এই নির্মিতিগুলি তৈরীটাকে এপ্রোচ করতে পারে।

সংক্ষেপে: ফরাসী দর্শনের মুর্হূতটা আবৃত হয়ে আছে জার্মান চিন্তার একটা নতুন আত্মসাতকরণ এ, বিজ্ঞানকে একটা সৃজনশীল কাজ হিসাবে দেখাতে, একটা মৌলিক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় এবং শিল্প ও জীবনের জন্য নতুন নির্মিতিগুলির একটা খোঁজে। এসব প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে একটা সাধারণ প্রচেষ্টা দেখা যায়, যা হচ্ছে ধারণার জন্য একটা নতুন অবস্থান বা অ-অবস্থান: ধারণা এবং তার বাহ্যিক অবস্থার মধ্যে সর্ম্পকটাকে সরিয়ে দেয়া অস্তিত্ব, চিন্তা, কাজ এবং নির্মিতিগুলির গতির সাথে নতুন সর্ম্পক গড়ে তোলার মাধ্যমে। এটা দার্শনিক ধারণা এবং বাহ্যিক পরিবেশের মধ্যে সর্ম্পকের মহত্ব যা বিশ-শতকের ফরাসী দর্শনের উদ্ভাবনের সীমানাকে চিহ্নিত করেছে।

লেখালেখি, ভাষা, নির্মিতি

নির্মিতির প্রশ্নটা, এবং নির্মিতিগুলির সৃষ্টির সাথে দর্শনের ঘনিষ্ঠ সর্ম্পকগুলির সংকটপূর্ণ গুরুত্ব আছে। স্পষ্টভাবে, এটা দর্শনের নিজের নির্মিতির বিষয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন উত্থাপন করে: নতুন দার্শনিক নির্মিতি ছাড়া কারো পক্ষে ধারণাকে স্থানচ্যুত করা সম্ভব নয়। সুতরাং নতুন ধারণাগুলি তৈরী করার ব্যাপার ছিল না, বরং দর্শনের ভাষাকে রূপান্তর করার ব্যাপার। দর্শন এবং সাহিত্যের মধ্যে বেড়ে উঠা এই একমাত্র মৈত্রীটা সাম্প্রতিক ফরাসী দর্শনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলির একটা। এখানে, অবশ্যই, একটা বড় ইতিহাস আছে। আঠারো শতকের পরিচিত সেই কাজগুলি, যাকে ফিলসফস (
philosophes) বলা হয় - ভলতেয়ার, রুশো, ড্রেডয়েট - যারা ফরাসী সাহিত্যের ক্ল্যাসিক; এই লেখকরা একদিক দিয়ে এই যুদ্ধপরবর্তী মৈত্রীদের পূর্বপুরুষ। এখানে অসংখ্য ফরাসী লেখক আছেন, যাদেরকে আলাদা করে দার্শনিক বা সাহিত্যের মধ্যে ফেলতে পারবেন না; উদাহারণ হিসাবে বলা যায় পাস্কাল এর নাম, যিনি ফরাসী সাহিত্যের একজন মহান ব্যক্তিত্ব, আবার একইসাথে অন্যতম ফরাসী চিন্তাবিদ। বিশ শতকের অ্যালান, যার সব অভিপ্রায়গুলি এবং উদ্দেশ্যগুলি ছিল একজন ক্ল্যাসিক্যাল দার্শনিকের এবং যিনি এই মুহূর্তের অংশীদার নন, যা এখানে আমাদেরকে ভাবাচ্ছে, খুব ঘনিষ্ঠভাবে সাহিত্যের সাথে জড়িত ছিলেন; লেখার প্রক্রিয়াটা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং উপন্যাসগুলির উপর তার অনেক কমেন্ট্রি আছে - বালজাকের উপর তার টেক্সটগুলি খুবই মজার - এবং ফরাসী কবিতার উপর তার কমেন্ট্রি, বিশেষ করে ভালেরির। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিশ শতকের ফরাসী দর্শনের আরো কনভেনশনাল চেহারাগুলি দিয়েও দর্শন এবং সাহিত্যের মধ্যে এই মিলটা তুলে ধরা যাবে।

সুরিয়ালিস্টরাও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নির্মিতিগুলির উৎপাদনে, আধুনিকতা, শিল্পের ক্ষেত্রে তারাও অধীর ছিলেন সর্ম্পকগুলিকে ঝাঁকিয়ে তুলতে; তারা চাইছিলেন জীবনের নতুন উপায়গুলিকে আবিষ্কার করতে। যদি তাদের একটা বড় এসথেটিক প্রোগ্রাম থাকতো, এটা ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকের দার্শনিক প্রোগ্রামগুলিকে একটা পথ দেখিয়ে দিতে পারতো; উদাহারণ হিসাবে লাঁকা এবং লেভি-ত্রস্ত সুরিয়ালিস্টিক সার্কেলগুলিতে নিয়মিতই যেতেন। এটা একটা জটিল ইতিহাস, কিন্তু ফ্রান্সে সুরিয়ালিস্টরা যদি বিশ শতকের এসথেটিক এবং দর্শনের সমধর্মীতার প্রথম প্রতিনিধিত্বকারী হয়, ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে এটা দর্শন, যে তার নিজস্ব সাহিত্যিক নির্মিতিগুলি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়েছে, দার্শনিক স্টাইল এবং উপস্থাপনের মধ্যে একটা সরাসরি অভিব্যক্তিপূর্ণ সংযোগ খোঁজার চেষ্টায় এবং ধারণার জন্য একটা নতুন অবস্থান তৈরী করার জন্য যা এটা প্রস্তাব করেছে।

এটা এমন একটা পর্যায়, যেখানে দার্শনিক লেখার ক্ষেত্রে একটা বিশাল পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি। চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, হয়তো আমরা দেল্যুজ, ফুকো, লাঁকা’র ভাষায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি; আমরা ভুলে গেছি আগেকার দার্শনিক স্টাইল যা প্রকাশ করতো তার সাথে কী অসাধারণ বিচ্ছেদ এটা তৈরী করেছে। সমস্ত দার্শনিকরা তাদের নিজস্ব স্টাইলটা খুঁজে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন, একটা নতুন গদ্য উদ্ভাবন করার চেষ্টা করেছেন; তারা লেখক হতে চেয়েছেন। দেল্যুজ বা ফুকো পড়ার সময় একজন দেখতে পাবে বাক্য বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোন পূর্বপ্রস্তুতি নাই, চিন্তা এবং ভাষায় প্রকাশের মধ্যে যে মুভমেন্ট তা পুরোপুরি অরিজিনাল। এখানে একটা নতুন, হ্যাঁ-সূচক রিদম এবং একটা বিহ্বল করা আমন্ত্রণ এর গঠনগগুলিতে। দেরিদা খুব ধৈর্য্যশীল, ভাষা থেকে ভাষার সর্ম্পকের ক্ষেত্রে জটিল, যেহেতু ভাষা নিজের উপর কাজ করে এবং চিন্তা শব্দগুলির কাজের মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর লাঁকাঁ পড়তে গেলে একজনকে চোখ-ধাঁধানো জটিল সিনটেক্স এর সাথে রেসলিং করতে হবে যা আসলে মোটেই মালার্মের সিনটেক্স মতো না, এবং যার ফলে কাব্যিক - স্বীকার করতে গেলে, তাই।

এখানে, তাই, দার্শনিক প্রকাশের একটা রূপান্তর এবং দর্শন ও সাহিত্যের মধ্যে সীমান্তগুলিকে সরিয়ে দেয়ার একটা প্রচেষ্টা দুটোই ঘটেছে। আমরা আরেকটা উদ্ভাবনের কথা মনে করতে পারি যে, সার্ত্র একজন ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার ছিলেন (যেমনটা আমি)। ফরাসী দর্শনের এই মুহূর্তের সুনির্দিষ্টতাটা ভাষার বিভিন্ন তালিকার উপর খেলাটা, দর্শন এবং সাহিত্যের মধ্যে, দর্শন এবং নাটকের মধ্যে সীমানগিুলিকে স্থানচ্যুত করার মধ্যে। কেউ এরকমটাও বলতে পারে যে, ফরাসী দর্শনের একটা লক্ষ্য হচ্ছে লেখালেখির জন্য একটা নতুন স্পেস তৈরী করা, যেখানে দর্শন এবং সাহিত্যকে আলাদা করা অসম্ভব হবে; একটা এলাকা যেটা দর্শন বা সাহিত্য হিসাবে বিশেষায়িত হবে না, বরং এক ধরণের লেখার জায়গা হবে যেখানে সাহিত্য থেকে দর্শনের জট খোলা অসম্ভব হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একটা স্পেস, যেখানে ধারণা এবং জীবনের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক কোন পার্থক্য নাই, এই ধরণের লেখায় উদ্ভাবনের একটা আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে ধারণার জন্যে একটা নতুন জীবন দেয়া: একটা সাহিত্যিক জীবন।

ফ্রয়েডের সাথে এবং বিপক্ষে

শেষমেশ, সীমানার ক্ষেত্রে, নতুন লেখালেখির এই উদ্ভাবনটাতে, নতুন সাবজেক্টটাকে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে; দর্শনের মধ্যে এই চেহারা তৈরী করার মধ্য দিয়ে এবং তার আশেপাশের যুদ্ধক্ষেত্রগুলি পুনঃনির্মাণের মাধ্যমে। সেজন্য এটা আর যুক্তিপূর্ণ, সচেতন সাবজেক্ট রইলো না, যা দের্কাতের কাছ থেকে আমাদের পর্যন্ত এসেছে; এটা আর হতে পারে না, আরো টেকনিক্যাল প্রকাশ ব্যবহার করা, আত্মবাচক সাবজেক্ট। সাম্প্রতিককালের মানবিক সাবজেক্ট হতে হবে এমন যা আরো মলানুসন্ধিৎসু, জীবন এবং শরীরের আরো বেশি সংমিশ্রিত, কার্তেজীয় মডেলের চাইতে আরো বেশি ব্যাপক, উৎপাদনের বা সৃজনের একটা প্রক্রিয়ার প্রতি আরো বেশি সমগোত্রীয়, যা তার নিজের ভিতরের আরো বেশি সম্ভাবনার প্রতি মনোযোগী। সাবজেক্ট এর নামটা নেয়া হবে কিনা, সেটাই ফরাসী দর্শন খুঁজে পেতে, স্পষ্টভাবে বলতে, চিন্তা করতে চেষ্টা করছে। যদি মনোবিশ্লেষণ একটা সংবাদী হয়, এর কারণ ফ্রয়েডের উদ্ভাবনটাও আসলে, বলতে গেলে, সাবজেক্টের জন্য একটা নতুন প্রস্তাব। যার জন্য ফ্রয়েড অচেতনতার (
unconscious) ধারণাটার উপস্থাপন করেছিলেন, মানবিক সাবজেক্টের মতের ক্ষেত্রে, যা সজ্ঞানতার (consciousness) চাইতেও বড় একটা কিছু - যা সজ্ঞানতাকে ধারণ করে, কিন্তু এটাকে এখানেই সীমাবদ্ধ রাখে না; এটাই ‘অচেতন’ শব্দটার মূল বিষয়টা।

সাম্প্রতিক ফরাসী দর্শন তাই মনোবিশ্লেষণের সাথে একটা দীর্ঘ-দৌড়ের সংলাপে লিপ্ত রয়েছে। এই বিনিময়টা ব্যাপক জটিলতার একটা নাটক, এটার নিজের এবং তার ভেতরের গভীর উন্মোচন। এই ইস্যুতে, সবচেয়ে মৌলিকভাবে ফরাসী দর্শন দুইভাগে বিভক্ত হয়েছে, একদিকে আমি বলবো একটা বাহ্যিক প্রাণবাদ, যা বার্গসঁ থেকে শুরু হয়ে সার্ত্র, ফুকো এবং দেল্যুজ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে, অন্যদিকে একটা ধারণাগত বিন্যাস, যা বার্ণশেভ থেকে শুরু হয়ে আলুথাসর এবং লাঁকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। যেখানে দুটি পথ সাবজেক্ট এর প্রশ্নে এসে পরস্পরকে অতিক্রম করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সংজ্ঞায়িত হতে পারে, ফরাসী দর্শনের প্রেক্ষিতে, যেহেতু এটা অস্তিত্ব (
being) হিসাবে ধারণাকে তুলে আনে। একটা নির্দিষ্টভাবে, ফ্রয়েডীয় অচেতনতা, একই স্পেস দখল করে রাখে; অচেতনতাও জরুরী একটা কিছু বা বর্তমান যা উৎপাদন করে, সামনে বহন করে নিয়ে চলে ধারণাকে। কিভাবে একটা অস্তিত্ব একটা ধারণাকে বহন করে নিয়ে যেতে পারে, কিভাবে একটা দেহের বাইরে কোনকিছু সৃজন করা সম্ভব? এটা যদি কেন্দ্রীয় সমস্যা প্রশ্ন হয়ে থাকে তাহলে আমরা দেখতে পাবো, কেন দর্শন মনোবিশ্লেষণ এর সাথে এতোটা তীব্র বিনিময়ের মধ্যে নিয়ে এসেছে। প্রকৃতিগতভাবে, সেখানে সবসময় একটা সংঘর্ষ বাধে, যেখানে সাধারণ লক্ষ্যগুলির দিকে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায়গুলি আছে। এখানে দুস্কর্মে সহযোগিতার একটা উপাদান আছে - তুমি ঠিক একই কাজ করছো, যেটা আমি করেছি - আবার শত্র“তাও আছে - তুমি এটা ভিন্নভাবে করছো। ফরাসী দর্শনে দর্শন এবং মনোবিশ্লেষণের মধ্যে সর্ম্পকের জায়গাটা এটাই, প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দুর্স্কমে সহযোগিতা, মুগ্ধতা এবং বৈরিতা, ভালোবাসা এবং আঘাত দেয়া। কোন সন্দেহ নাই, তাদের মধ্যে নাটকটা খুবই হিংস্র, খুবই জটিল।

তিনটা মূল টেক্সট হয়তো এর একটা ধারণা দিতে পারে। প্রথমে হয়তো দুর্স্কমে সহযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতার সবচেয়ে পরিষ্কার উদাহারণটা হতে পারে বের্চাড এর ১৯৩৮ এ শুরুর দিকের কাজ
La psychanalyse du feu তে। বের্চাড একটা নতুন মনোবিশ্লেষণের প্রস্তাব করেন, যার ভিত্তি হবে কবিতা এবং স্বপ্ন, উপাদানগুলির একটা মনোবিশ্লেষন - আগুন, পানি, বাতাস এবং পৃথিবী। কেউ বলতে পারে যে, বের্চাড ফ্রয়েডের অবদমনকে (inhibition) প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছেন স্বপ্নালোক দিয়ে, প্রদর্শন করতে চেয়েছেন যে, এটা অনেক বড় এবং খোলা ক্যাটাগরি। দ্বিতীয় টেক্সটা আসে, সার্ত্রের বিয়িং এন্ড নাথিংনেস থেকে, তার ক্ষেত্রে, তিনি প্রস্তাব করছেন, আরেকটা নতুন মনোবিশ্লেষনের, ফ্রয়েডের ‘প্রায়োগিক’ মনোবিশ্লেষণের সাপেক্ষে তার নিজস্ব (সংশ্লিষ্টকরণ এর মাধ্যেমে) সঠিকভাবে তাত্ত্বিক অস্তিত্বশীল মডেলের। সার্ত্র ফ্রয়েডের কমপ্লেক্সকে, অচেতনতার গঠনটার প্রতিস্থাপন খুঁজেছেন, যেটাকে তিনি বলেছেন ‘আসল পছন্দ’ (‘original choice’) বলে। তার ক্ষেত্রে, সাবজেক্টকে যা সংজ্ঞায়িত করে তা একটা গঠন নয়, স্নায়ুবৈকল্যগ্রস্ততা বা ন্যায় ভ্রষ্টতা, যা কিন্তু অস্তিত্বেরই একটা মৌলিক প্রকল্প। আবারও, একটা দুস্কর্মে সহযোগিতা এবং শত্র“তা একসাথে দেখতে পাওয়ার উদাহারণ।

তৃতীয় টেক্সটা এসেছে, দেল্যুজ এবং গুট্টেরীর এন্টি-অডিপাস এর ৪ নম্বর অধ্যায় থেকে। এখানে, দেল্যুজ মনোবিশ্লেষণকে প্রতিস্থাপিত করার কথা বলেছেন একটা মেথড এর মাধ্যমে, যাকে তিনি বলেছেন, সিজোঅ্যানালাইসিস, ফ্রয়েডিয়ান বিশ্লেষণের সাথে তিনি খোলাখুলি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। বের্চাড এর ক্ষেত্রে এটা ছিল স্বপ্নালোক অবদমনের তুলনায়, সার্ত্রের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটা প্রকল্প একটা জটিলতার চাইতে। আর দেল্যুজ এন্টি-অডিপাস এ পরিষ্কার করলেন এই বলে যে, এটা একটা নির্মাণ, একটা প্রকাশের চাইতে; মনোবিশ্লেষণের প্রতি তার প্রধান আপত্তিটা হলো যে, এটা অচেতনাটাকে প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনকিছুই করে না, প্রয়োজন হচ্ছে এটাকে নির্মান করার। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ফ্রয়েডিয়ান প্রকাশ’ কে প্রতিস্থাপিত করার জন্য, যা হচ্ছে সিজোঅ্যানালাইসিসের কাজ। এটা চমক-লাগানো বললেও কম বলা হবে যে, বের্চাড, সার্ত্র এবং দেল্যুজ এর মতো মহান তিনজন দার্শনিক প্রত্যেকেই মনোবিশ্লেষণকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছেন তাদের নিজস্ব একটা মডেলের মাধ্যমে।

মহান হওয়ার পথ

শেষমেশ, একটা দার্শনিক মুহূর্তকে তার নিজস্ব চিন্তার প্রোগ্রাম দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা। যুদ্ধ পরবর্তী ফরাসী দর্শনের জন্য আমরা পরিভাষার মাধ্যমে কী সাধারণ ভিত্তি সংজ্ঞায়িত করতে পারি, এর কাজগুলি বা প্রণালীগুলি বা এর ধারণাগুলির মধ্যে নয়, কিন্তু এর বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্রমগুলির মধ্যে? দার্শনিকরা, অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের চরিত্র এবং এধরণের একটা কার্যক্রমের প্রতি বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখাবেন। তারপরও, যেখানে আপনার অধিক গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন আছে, যা যুক্তভাবে স্বীকার্য, সেখানে আপনার একটা দার্শনিক মুর্হূত আছে, একটা বড় বৈচিত্রের উপায়গুলির, টেক্সটগুলির এবং চিন্তাবিদদের মধ্যে। আমরা কার্যক্রমের মূল পয়েন্টগুলিকে এভাবে নিচে সংক্ষিপ্তকরণ করতে পারি যা যুদ্ধ পরবর্তী ফরাসী দর্শনকে উদ্ধুদ্ধ করেছিল -

১. ধারণা এবং অস্তিত্বের বিচ্ছেদের বিষয়ে কিছু করা - এই দুটিকে বিরোধিতা না করা; এটা প্রদর্শন করা যে, ধারণা একটা জীবন্ত বিষয়, একটা সৃজন, একটা প্রক্রিয়া, একটা ঘটনা এবং এভাবে অস্তিত্বের সাথে বিচ্ছেদিত কিছু না
২. আধুনিকতার সাথে দর্শনকে উৎকীর্ণ করা, যা আরো বোঝায় যে, তাকে অ্যাকাডেমি থেকে বের করে নিয়ে এসে প্রাত্যহিক জীবনের প্রবাহে স্থাপন করা। যৌনতার আধুনিকতা, শৈল্পিক আধুনিকতা, সামাজিক আধুনিকতা: দর্শনকে এসব কিছুর সাথে জড়িত হতে হবে;
৩. জ্ঞানের দর্শন এবং কাজের দর্শন মধ্যেকার বিরোধিতাকে, তত্ত্বীয় এবং প্রায়োগিক যুক্তির মধ্যে বিভাগকে পরিত্যাগ করা এবং এটা দেখানো যে, জ্ঞান নিজে, এমনকি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানও হচ্ছে একটা প্রয়োগ
৪. দর্শনকে সরাসরি রাজৗনতিক ক্ষেত্রের মধ্যে অবস্থিত করা, রাজনৈতিক দর্শনের ঘোরাপথে না গিয়ে; যাকে আমি বলবো, ‘দার্শনিক জঙ্গি’ উদ্ভাবন করা; দর্শনকে তার উপস্থিতির ভিতর, তার হয়ে উঠার ভিতর একটা রণমুখী প্রয়োগ হিসাবে তৈরী করা: শুধুমাত্র রাজনীতির একটা প্রতিফলন নয়, বরং একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
৫. সাবজেক্ট এর প্রশ্নটাকে প্রত্যাখান করা, আত্মবাচক মডেলকে অস্বীকার করা, এবং এভাবে মনোবিশ্লেষণের সাথে জড়িত হওয়া - তার শত্র“তা করা, সম্ভব হলে তাকে উন্নত করা
৬. দার্শনিক ব্যাখ্যার একটা নতুন ধরণ সৃজন করা, আর এভাবে সাহিত্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, প্রয়োজনীয়ভাবে, আঠারো শতকের দার্শনিক-লেখক এর চরিত্রটাকে সাম্প্রতিক পরিভাষায় পুনারাবিষ্কার করা।

এটাই ফরাসী দর্শনের মুহূর্তটা, তার কার্যক্রম, তার সুউচ্চ উচ্চাকাঙ্খা। এটাকে আরো দূর পর্যন্ত চিহ্নিত করতে গেলে যায়, এর একটা অপরিহার্য বাসনা হচ্ছে - প্রত্যেকটা পরিচয়ই হচ্ছে একটা বাসনার পরিচয় - দর্শনকে লেখালেখির একটা সচল রূপ হিসাবে পরিবর্তিত করা, যা নতুন সাবজেক্ট এর একটা মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে। আর একই নিদর্শনস্বরূপ, দার্শনিকের ধ্যানমগ্ন বা প্রফেসর ইমেজটাকে মুছে ফেলা; দার্শনিককে ধ্যানীর চাইতে অন্যকিছু হিসাবে তৈরী করা, পাদ্রীর প্রতিপক্ষের চাইতে অন্যকিছু। বরং, দার্শনিক উচ্চাকাঙ্খা-তাড়িত একজন লেখক-যোদ্ধা হয়ে উঠার জন্য, সাবজেক্ট এর শিল্পী, উদ্ভাবন এর একজন প্রেমিক হওয়ার জন্য - এসব বাসনার নামের কথা বলা যায়, যা এই সময়ের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে: এই বাসনা যে দর্শন তার নিজের নামের উপর কাজ করবে। আমার মনে পড়ছে গধষৎধীঁ এর সেই বানীটার কথা, যেটা তিনি ফব এধঁষষব কে বলেছিলেন, তার খবং পযল্গহবং য়ঁ’ড়হ ধনধঃ তে : ‘মহান হওয়া হচ্ছে এমন একটা কিছুর দিকে যাত্রা করা, যা কেউ জানে না।’ মৌলিকভাবে, বিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে, দার্শনিক মুহূর্তটা প্রস্তাব করেছিল যে, দর্শনের সেই পথকেই পছন্দ করা উচিত, যার উদ্দেশ্যগুলি সে জানতো, যে তার দার্শনিক কাজ বা হস্তক্ষেপ বেছে নেয়া উচিত বিজ্ঞতা এবং ধ্যানের উপর। এটা বিজ্ঞতাবিহীন দর্শন যাকে আজকে দোষারোপ করা হয়।

কিন্তু ফরাসী দার্শনিক মুহূর্তটা সুখের চাইতে মহান হওয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী। আমরা চাইছিলাম সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক একটা কিছু, এবং যা সর্বজনস্বীকৃত সমস্যাকরণ: আমাদের বাসনা ছিল ধারণার অ্যাডভেন্চারগুলি। আমরা জীবন এবং ধারণার মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন খুঁজছিলাম না, বা ভাবনার বা নিয়মের প্রতি অস্তিত্বের অধীনতাও না। বরং, আমরা চাইছিলাম, ধারণা নিজেই একটা ভ্রমণ হয়ে উঠুক, যার গন্তব্য হয়তো আমরা নাও জানতে পারি। এই বৈশিষ্ট্যসূচক অ্যাডভেন্চারটা, দুর্ভাগ্যবশত, সাধারণভাবে, একটা নিয়মের বৈশিষ্ট্যসূচক দিয়ে অনুসৃত হয়েছে। এটা হয়তো বোঝা যায় - এই দর্শনের একটা জলদস্যুসুলভ দিক আছে অথবা একটা যাযাবরসুলভ, যেমনটা দেল্যুজ হয়তো বলতেন। তথাপি, “ধারণাগুলির অ্যাডভেন্চার” একটা সূত্র হতে পারে যেটা আমাদের সবাইকে একত্রিত করে; এবং এভাবে আমি যুক্তি দেখাতে পারি যে, বিশ শতকের শেষদিকে ফ্রান্সে যা ঘটেছিল, শেষ পর্যন্ত তা ছিল, দার্শনিক অ্যাডভেন্চারের একটা মুহূর্ত।

বাংলা অনুবাদের নোট:
এই লিখাটাতে বাদিউ’র প্রস্তাব মূলতঃ দুইটা - ফরাসী দর্শনের নির্দিষ্ট সময়টাকে দর্শনের একটা বিশেষ মুহূর্ত বলে গণ্য করা এবং সেই মুর্হূতের বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করা। দর্শনের এইরকম মুর্হূত হিসাবে তিনি উল্লেখ করছেন আরো দুইটা ঘটনার কথা - প্রাচীন গ্রীক দর্শন এবং আঠারো শতকের জার্মান দর্শনকে। যার বৈশিষ্ট্যকে তিনি বলছেন একইসাথে বৈশ্বিক এবং নির্দিষ্ট। আমার কাছে আরো মনে হৈছে যে, চিন্তাগুলির ছড়িয়ে পড়তে পারাটাই হয়তো এর বৈশ্বিকতা। যেমন গ্রীক দর্শনের শুরুটাকে তিনি ধরছেন প্যারামানডেস (খ্রীষ্টপূর্ব ৫১০ - খ্রীষ্টপূর্ব ৪৫০) থেকে অ্যারিষ্টটল (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪ - ৭ই মার্চ, খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২) পর্যন্ত - এর মাঝখানে অবস্থিত গ্রীক চিন্তাবিদদের ধারণাগুলিই পরবর্তীকালের ইসলামিক কিংবা ক্রিশ্চিয়ান চিন্তাকে প্রভাবিত করছে, যা বিশ্বব্যাপী তার ধারণাগত অভিযানকে পরিচালিত করছে। একইভাবে জার্মান ক্ল্যাসিকাল চিন্তাও, শুধুমাত্র জার্মানীতেই না সারা ইউরোপ থেকে শুরু করে আম্রিকা, এশিয়া, আফ্রিকাতে তার চিন্তার চিহ্ন রাখছে, কারো পক্ষেই তাকে অস্বীকার করা যায় নাই। একইভাবে সার্ত্র থেকে দেল্যুজের এই যে পরিক্রমা তাকেও একই সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, এই মুর্হূতটার বৈশিষ্ট্যগুলি হিসাবে বাদিউ চারটা পয়েন্ট দাঁড় করাইছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখানে যেমন, অ্যালান অর্ন্তভুক্ত হৈতে পারেন নাই, তেমনি বদ্রিয়াঁও অর্ন্তভুক্ত নন। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষিতে বা প্রশ্নের ভিত্তিতেই ক্রমটা চিহ্নিত। আর সম্ভবত এই বৈশিষ্ট্যগুলির আলোচনায় ফুকো এবং দেল্যুজের কিছু মিল আমরা দেখতে পাবো, সংক্ষেপে:
১. জার্মান দর্শনের একটা ক্রম হিসাবে নিটশে'কে একটা রেফারেন্স হিসাবে ব্যবহার করা
২. দর্শনকে রাজনৈতিক প্রশ্নের সাথে জড়িত করা,
৩. ভাষার জন্য নতুন একটা ইথিকসের সন্ধান করা
৪. দর্শন ও মনোবিশ্লেষণের প্রশ্নে অবস্থানগত ঐক্য পোষন করা
আর এইভাবে দেখতে গেলে এই বইটা হয়তো একটা চেষ্টা যে, কিভাবে ফুকো ও দেল্যুজ তাদের দর্শন-চিন্তাকে রাজনীতির সাথে সম্পৃত্ত করতে চাইতেছেন, তার কিছু নমুনা। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, বাদিউ’র রাজনৈতিক অবস্থান কখনোই ফুকোর সাথে যায় নাই এবং দেল্যুজের ‘ঘটনা’ চিন্তারও তিনি ছিলেন একজন কঠিন সমালোচক।
এই বাংলা অনুবাদটি কবিসভাতে প্রচারিত হৈছিল, ২০০৬ সালে।
মূল ইংরেজী সূত্র: দি নিউ লেফট রিভিউ ৩৫, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৫।
http://newleftreview.co.uk/Issue35.asp?Article=04

No comments: