Wednesday, May 7, 2008

বুদ্ধিচর্চাকারীগণ এবং ক্ষমতা: মিশেল ফুকো এবং গিলেজ দেল্যুজ-এর মধ্যে আলাপচারিতা

বুদ্ধিচর্চাকারীগণ এবং ক্ষমতা:
মিশেল ফুকো এবং গিলেজ দেল্যুজ-এর মধ্যে আলাপচারিতা


মিশেল ফুকো : একবার একজন মাওবাদী আমাকে বলেছিলেন যে, ‘আমি খুব সহজেই বুঝতে পারি সার্ত্রের আমাদের সাথে থাকার উদ্দেশ্যটা; আমি বুঝতে পারি তার লক্ষ্যগুলি এবং রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণটাকে; আমি আপনার অবস্থানটাও কিছুটা বুঝতে পারি, যেহেতু আপনি বন্দিত্বের সমস্যা নিয়া সবসময় চিন্তিত আছেন। কিন্তু দেল্যুজ আমার কাছে একটা বিভ্রান্তি।’ আমি তার এই মন্তব্যে হতভম্ব, কেননা আপনার অবস্থান আমার কাছে সবসময় বিশেষভাবে স্পষ্ট মনে হয়েছে।

গিলেজ দেল্যুজ : সম্ভবত আমরা তত্ত্ব এবং বাস্তব প্রয়োগের একটা নতুন সম্পর্কের যে প্রক্রিয়া, তার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় মনে করা হতো যে, বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে তত্ত্বের একটা ব্যবহৃত রূপ, এরই একটা ফলাফল; আবার আরেকটা সময়ে, এর বিপরীত একটা ধারণা আছে এবং ভাবা হতো যে সেটা তত্ত্বকে উদীপ্ত করে, যা ভবিষ্যতের তত্ত্বের অবয়ব সৃষ্টি করার জন্য অপরিহার্য একটা বিষয়। যে কোনো ক্ষেত্রেই, তাদের সম্পর্ককে দেখা হতো একটা সামগ্রিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটাকে আমরা ভিন্নভাবে দেখছি। তত্ত্ব এবং বাস্তব প্রয়োগের বিষয়টা অনেক বেশি অসম্পূর্ণ এবং খন্ডিত। এক দিক দিয়ে, তত্ত্ব সবসময় স্থানীয় একটা ব্যাপার এবং সবসময় একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র নিয়া থাকে, কিন্তু এটা প্রযোগ করা হয় অন্য আরেকটা ক্ষেত্রের উপর, যা কম বেশি এর থেকে ভিন্ন। একটা তত্ত্বের ব্যবহারের সাথে যে সম্পর্ক তা কখনোই সাদৃশ্যমূলক না। আরো ভালোভাবে বলতে গেলে, যখন একটা তত্ত্ব তার সঠিক এলাকাতে প্রবেশ করে, তখন সে মুখোমুখি হয় বাধাগুলির, দেয়ালগুলির এবং অবরুদ্ধ-অবস্থাগুলির যার প্রয়োজন হয় অন্য ধরনের ডিসকোর্সগুলিতে রিলে করার জন্য (আর এটা অনান্য ডিসকোর্সে যাওয়ার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অন্য আরেকটা এলাকায় প্রবেশ করে)। বাস্তব প্রয়োগ হচেছ একটা তত্ত্বীয় জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় যাওয়ার একটা রিলের ক্রম এবং তত্ত্ব হচ্ছে একটা প্রয়োগ থেকে আরেকটাতে যাওয়ার রিলে পথ। কোনো একটা দেয়ালের সম্মুখীন হওয়া ছাড়া কোনো তত্ত্ব তৈরি হতে পারে না আর বাস্তব প্রয়োগটা জরুরি সেই দেয়ালটাকে ছিদ্র করার জন্য। উদাহারণস্বরূপ, আপনার কাজ শুরু হয়েছিল বন্দিত্ব নিয়া তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর একটা পুঁজিবাদী সমাজে মানসিক হাসপাতালের কাজ-কর্মের প্রেক্ষিতে। তারপর আপনি সচেতন হয়ে উঠলেন সীমাবদ্ধ মানুষজনের তাদের নিজেদের নিয়ে কথা বলার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে, একটা রিলে পথ তৈরি করার জন্য (আবার বিপরীতভাবে, এটাও সম্ভব যে, আপনার কাজ প্রথম থেকেই তাদের সম্পর্কে একটা রিলে হয়ে ছিল); আর সেই দলটা ছিল হাজতে-সেই মানুষগুলি ছিল কয়েদে। আর এই ভিত্তিতে আপনি সংগঠিত করলেন ইনফরমেশন গ্র“প অফ প্রিজনস (জি.আই.পি.)১, একটা জায়গা যেটা শর্তগুলি তৈরি করেেলা যাতে কয়েদীরা নিজেদের সর্ম্পকে কথা বলার অনুমতি পেলো। এটা বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে, যেমনটা মাওবাদী লোকটি বলেছেন যে, এই প্রাকটিসের মধ্যে দিয়ে আপনি আপনার তত্ত্ব প্রয়োগ করছেন। এটা একটা বাস্তব প্রয়োগ ছিল না কিংবা সংস্কারের জন্য বা সনাতন ভাবধারার প্রতি ইনকোয়ারির কোনো প্রজেক্ট ছিল না। এর গুরুত্বটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় : একটা বিশাল বলয়ের মধ্যে রিলেগুলির একটা শৃঙ্খলা, অসংখ্য অংশগুলির মধ্যের একটা যারা একইসাথে তত্ত্বীয় এবং প্রায়োগিক। একজন তত্ত্বীয় বুদ্ধিচর্চাকারী, আমাদের জন্য, শুধুমাত্র একটা বিষয় নন, সজ্ঞানতার একটা প্রতীক অথবা একজন প্রতিনিধিত্বকারী। যে কাজ করে এবং সংগ্রাম করে সে আর প্রতিনিধিত্বকারী নয়, কোনো একটার মাধ্যমেও না, একটা গ্র“প অথবা একটা ইউনিয়ন যারা তাদের বিবেকের পক্ষে দাঁড়ানোটারে যথোপযুক্ত মনে করে। আর যে বলে আর কাজ করে? এটা সবসময় অসংখ্য একটা ব্যাপার, এমনকি একটা মানুষের মধ্যেও যে কথা বলে এবং কাজ করে। আমরা সবাই হচ্ছি ‘গ্র“পসকোলস’ (
groupuscules)২। প্রতিনিধিত্বতা কখনোই বিরাজ করে না; এইখানে শুধুমাত্র ক্রিয়া আছে-তত্ত্বীয়-ক্রিয়া এবং প্রায়োগিক-ক্রিয়া, যা রিলেগুলি হিসাবে কাজ করে এবং নেটওর্য়াক তৈরি করে।

ফুকো : আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ঐতিহ্যগতভাবে দেখা হয়েছে তার কাজ-কর্মের দুইটা ভিন্নরূপের ফলাফল হিসাবে : বুর্জোয়া সমাজে একজন বুদ্ধিচর্চাকারী হিসাবে তার অবস্থান হিসাবে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং যে ভাবাদর্শ এটা তৈরি করে বা চাপিয়ে দেয় (তার সুযোগ গ্রহণ, দারিদ্র, প্রত্যাখ্যান, যন্ত্রণা-ভোগ, নাশকতামূলক কাজ-কর্মের অভিযোগগুলি, দুষ্কর্ম ইত্যাদি) তার উপর; এবং তার যথোচিত ডিসকোর্স যদ্দুর পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট সত্যকে উন্মোচন করে, রাজনৈতিক সর্ম্পকগুলিকে অনাবৃত করে, যেখানে তারা অশঙ্কিত (
unsuspected) ছিল। এই দুই ধরনের রাজনৈতিকীকরণ একটা আরেকটাকে বাদ দিয়া চলে না, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হওয়ার কারণে, তারা আবার সামঞ্জস্যপূর্ণও হয় না। কাউকে বলা হয় “বাদাইম্মা” (outcasts), আবার অন্যদের বলা হয় “সমাজতান্ত্রিক” (socialists)। কর্তৃত্বের অংশগুলির বিপক্ষে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার সময়গুলিতে এই দুই ধরনের অবস্থানগুলি স্পষ্টভাবে বের হয়ে আসে : ১৮৪৮ সালের পরে, কমিউনের পরে, আবার ১৯৪০-এ। বুদ্ধিচর্চাকারীদের বাতিল করা হয় এবং যন্ত্রণা দেয়া হয় সেই যথার্থ সময়ে, যখন ঘটনাগুলি অখন্ডনীয় ছিল, যখন এটা নিষিদ্ধ ছিল বলা যে, রাজার গায়ে কোনো কাপড় নাই। বুদ্ধিচর্চাকারীরা তাদেরকে এই কথা বলত যারা তখনও তা দেখে নাই, তাদের নামে বলত, যাদের জন্য সত্য বলা নিষিদ্ধ ছিল : সে ছিল বিবেক, সচেতনতা এবং বাগ্মী। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থানের পর৩ বুদ্ধিচর্চাকারীরা আবিষ্কার করলো যে, জনসাধারণের পক্ষে জ্ঞান অর্জনের জন্য আর তাদের প্রয়োজন নাই : কোনোরকম বিভ্রম ছাড়াই তারা খুব ভালোভাবে জানে, তার চাইতে এবং তারা অনেক বেশি জানে এবং তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে যথেষ্ঠই সক্ষম। কিন্তু এইখানে ক্ষমতার একটা শৃঙ্খল আছে, যা বাধা দেয়, নিষেধ করে, অকার্যকর করে এই ডিসকোর্সকে এবং এই ক্ষমতাকে, একটা ক্ষমতা যা শুধুমাত্র সেন্সরশিপের কর্তৃত্বের স্পষ্ট ধারাতেই পাওয়া যায় না, বরং একজন গভীরভাবে ও সূক্ষভাবে দেখতে পাবে সমগ্র সামাজিক নেটওর্য়াকের ভিতর। বুদ্ধিচর্চাকারীরা নিজেরাই এই ক্ষমতা শৃংখলার এক একজন এজেন্ট-তাদের “বিবেক”-এর প্রতি দায়িত্ববোধের ধারণাটা এবং ডিসকোর্স এই শৃঙ্খলার অংশ তৈরি করে। একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর ভূমিকা আর তাকে এই জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করে না যে, “একটু এগিয়ে থাকে আর পক্ষে থাকে” জনগণের দমন করা সত্যকে প্রকাশ করার জন্যে; বরং তার সংগ্রাম হচ্ছে ক্ষমতার রূপগুলির বিপক্ষে যা তাকে তার (ক্ষমতার) অবজেক্ট হিসাবে পরিবর্তিত করে এবং বিভিন্ন বলয়ের, যেমন “জ্ঞান”, “সত্য”, “বিবেক” এবং “ডিসকোর্স”-এর উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করে।৪

এইভাবে দেখতে গেলে, তত্ত্ব কখনোই প্রকাশ করতে, অনুবাদ করতে বা সেবা দিতে পারে না বাস্তব প্রয়োগকে ব্যবহার করার জন্যে : এটা হচ্ছে বাস্তব প্রয়োগ। কিন্তু এটা স্থানীয় এবং আঞ্চলিক, যেমনটা আপনি বলছেন, কোনো সামগ্রিক বিষয় না। এটা ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ, একটা যুদ্ধ যা উন্মোচন করতে চায় এবং দুর্বল করতে চায় ক্ষমতার ভিত্তিটাকে, যেখানে তাদের অবস্থান সবচেয়ে বেশি অনির্ণেয় এবং কুচক্রী। আমরা যেখানে যুদ্ধ করছি সেটা “বিবেক জাগিয়ে” তোলার কার্যক্রম না (জনগণ অনেক সময় বুঝতে পারে যে, সচেতনতা জ্ঞানেরই একটা রূপ; এবং আত্মনিষ্ঠতার দিক থেকে সচেতনতা বুর্জোয়াদেরই একটা বিশেষাধিকার), কিন্তু ক্ষমতাকে দুর্বল করার জন্যে, ক্ষমতা দখল করার জন্যে; এটা এমন একটা কার্যক্রম যা পরিচালনা করা হয় তাদের পাশাপাশি, যারা ক্ষমতার জন্যে লড়াই করে এবং একটা দূরত্বে থেকে তাদের অলংকার হিসাবে কাজ করে না। একটা “তত্ত্ব” এই সংগ্রামের একটা আঞ্চলিক শৃঙ্খলা।

দেল্যুজ : সংক্ষেপে, এইটা তা-ই। একটা তত্ত্ব হচ্ছে একটা বাক্সভর্তি যন্ত্রপাতি। এটা কী অর্থ বহন করে তা দিয়ে কিছু করার নাই। তাকে ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। তার অবশ্যই কার্যক্ষমতা থাকতে হবে। সে শুধুমাত্র তার নিজের জন্যে না। কেউ যদি এটা ব্যবহার না করে, এর আবিষ্কর্তা থেকে শুরু করে যে কেউ (কে আর তখন তাত্ত্বিক হতে চাইবে!), তাহলে এই তত্ত্ব কোনো কিছুই না অথবা সময়টা তার জন্যে অনুপযুক্ত। আমরা একটা তত্ত্বকে পুনরায় লিখি না বরং নতুন করে তৈরি করি; আমাদের নতুন একটা তৈরি করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকে না। এটা খুব আশ্চর্যজনক যে, প্র“স্ত, একজন লেখক, যিনি একজন খাঁটি বুদ্ধিচর্চাকারী হওয়ার কথা, খুব স্পষ্টভাবে এটা বলেছিলেন: আমার বইটাকে তুমি ধরে নাও একজোড়া চশমার মতো, যা দিয়ে তুমি বাইরেটাকে দেখবে; যদি এটা তোমার ভালো না লাগে আরেক জোড়া খুঁজে নাও; আমি এটা তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি, তুমি নিজের মতো করে হাতিয়ার খুঁজে নাও, যেটা জরুরি তা হচ্ছে সংগ্রাম করার জন্য বিনিয়োগ করা। একটা তত্ত্ব কখনো সম্পূর্ণতা দান করে না; এইটা গুণনের (
multiplication) একটা হাতিয়ার এবং এটা নিজেকেও মাল্টিপাই করে। ক্ষমতার প্রকৃতি সামগ্রিকতা আনতে চায় এবং এটা হচ্ছে আপনার অবস্থান। আর আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত যে, তত্ত্ব প্রকৃতিগতভাবে ক্ষমতার বিপক্ষে। একটা তত্ত্ব যখন নিজেকে একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে জড়িয়ে ফেলে তখন তার সামান্যতম কোনো বাস্তবিক গুরুত্ব থাকে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এটা অন্য আরেকটা ভিন্ন জায়গা দিয়ে বের হতে পারে। এইজন্যেই সংস্কারের ধারণা এতোটাই মূঢ় এবং ভন্ডামিপূর্ণ। সংস্কার প্রস্তাব করা হয় দুইটাভাবে, এটা তারা করে যারা এর প্রতিনিধিত্বকারী হতে চায়, যারা অন্যদের জন্যে কথা বলার একটা পেশা বেছে নেয়, তারা ক্ষমতার একটা ক্ষেত্ররে নেতৃত্ব দেয়, এই নতুন ক্ষমতার বিপণন করে যা অবদমনের মাত্রারে দিগুণ করে; অথবা তারা এটা করে তাদের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ বা দাবি থেকে। এই পরবর্তী কারণটা একটা সংস্কার না বরং বিপ্লবী কাজ যা ক্ষমতার টোটালিটিটাকে এবং এর ক্ষমতা পরম্পরাটাকে প্রশ্ন করে (তার আংশিকতার পুরা রূপটাকে প্রকাশ করে)। এটা অবশ্যই হাজতে দেখা যায় : সবচেয়ে ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন হাজতীদের দাবিগুলিও প্লেভেনএর (Pleven's) সংস্কারকে পাংচার করে দিতে পারে।৫ যদি কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের প্রতিবাদগুলি শোনা যেতো, তাদের প্রশ্নগুলিতে যদি মনোযোগ দেয়া হতো, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার জন্য তা যথেষ্ঠ ছিল। অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই যে, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো ধরনের সহনশীলতা নাই; এটা সবদিক দিয়েই এর চূড়ান্ত ভঙ্গুরতাকে প্রমাণ করে এবং তার প্রয়োজনে অবদমনের একটা বৈশ্বিক রূপায়ণকে প্রকাশ করে। আমার ধারণায়, আপনি-ই প্রথম, যিনি তার বইগুলিতে দেখিয়েছেন এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিখিয়েছেন যা সম্পূর্ণভাবে মৌলিক : অন্যদের জন্যে বলাটা অবমাননাকর (the indignity of speaking for others)। আমরা প্রতিনিধিত্ব করাটাকে কৌতুক করতাম এবং বলতাম যে, এটা শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আমরা এই “তাত্ত্বিক” জিনিসটার রূপান্তরের একটা পরিণতি টানতে ব্যর্থ হয়েছি-সেই তাত্ত্বিক ঘটনাকে উপলব্ধি করতে যে, যারা সরাসরিভাবে জড়িত তারাই প্রাকটিক্যালি তাদের পক্ষ নিয়ে বলতে সক্ষম।

ফুকো : এবং যখন হাজতীরা বলতে শুরু করলো, হাজত সম্পর্কে, পেনাল সিস্টেম সম্পর্কে তখন তারা বিচার সম্পর্কে একটা ব্যক্তিগত তত্ত্ব হাজির করলো। এটা এমন একটা ডিসকোর্স, যার একটা চরম মূল্য আছে, হাজতীদের এই কাউন্টার ডিসকোর্সটা হচ্ছে ক্ষমতার বিপক্ষে একটা ডিসকোর্স, যাদেরকে আমরা দুষ্কৃতিকারী বলি-আর এটা দুষ্কৃতি সম্পর্কে কোনো তত্ত্ব না। হাজতের সমস্যাটা হচ্ছে স্থানীয় এবং প্রান্তিক সমস্যা : প্রতি বছর ১০০,০০০ লোকের বেশি হাজতে যায় না। ফ্রান্সে বর্তমানে ৩০০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ লোক হাজতে আছে। কিন্তু এই প্রান্তিক সমস্যাটাই সবাইকে বিরক্ত করতেছে। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি যে, অনেক লোক যারা এর সাথে জড়িত না এই সমস্যাটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন, আরো আশ্চর্য হয়েছি যে, যারা এই ডিসকোর্সের ব্যাপারে কোনোদিন কিছু শোনে নাই তারাও এইটা খুব সহজেই বুঝতে পারছে। আপনি এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এটা কি এই কারণে না যে, পেনাল সিস্টেম হচেছ সেই রূপ যার মাধ্যমে ক্ষমতাকে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়? একজনকে হাজতে রাখা, তাকে খাদ্য এবং উত্তাপের ব্যাপারে সীমিত করা, বাইরে যাইতে বাধা দেয়া, ভালবাসাবাসি করতে না দেয়া, ইত্যাদি-এইসবই হচ্ছে ক্ষমতা সর্ম্পকে কল্পনার সবচাইতে ক্ষিপ্ত এবং স্পষ্ট প্রকাশ। আরেকদিন আমি এক মহিলার সাথে কথা বলছিলাম, যে একসময় হাজতে ছিল আর শে বলছিল : “চিন্তা করো, আমি চল্লিশ বছর বয়সের একজন মহিলা, আর আমারে একদিন শুকনা রুটি খাওয়ার শাস্তি দিল।” এই গল্পের সবচে স্ট্রাইকিং বিষয় ক্ষমতার শিশুসুলভ প্রয়োগটা না বরং ক্ষমতাকে ক্ষমতা হিসাবে ব্যবহার করার হতাশাবাদ, সবচেয়ে প্রাচীন, তুচ্ছ, বালসুলভভাবে প্রয়োগ করার দিকটা। একটা বাচ্চা হিসাবে আমরা বুঝতে পারি, রুটি আর পানি কমিয়ে দেওয়া কী বোঝায়। হাজত হচ্ছে একমাত্র জায়গা, যেখানে ক্ষমতা তার নগ্ন রূপটাকে প্রকাশ করে, সবচেয়ে অপরিমিতভাবে করে আর সেইখানে ন্যায্যতা দেওয়া হয় নৈতিকতার ভিত্তিতে। “আমার অধিকার আছে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার কারণ তুমি জান যে, কাউকে খুন করা বা ডাকাতি করা অপরাধ. . .” হাজতের ব্যাপারে সবচেয়ে মজার বিষয়টা হচ্ছে যে, ক্ষমতা এখানে নিজেরে আড়াল করে না বা কোনো মুখোশ পড়ে না; ক্ষমতা নিপীড়নের জন্য নিজেকে উন্মোচন করতে একদম পুঁচকে ঘটনাগুলিকেও ব্যবহার করে; এটা নৈরাশ্যবাদী আচরণ এবং একইসাথে শুদ্ধ এবং সম্পূর্ণভাবে “ন্যায্য”, কারণ এর প্রয়োগ পুরাপুরিভাবে নৈতিকতার ঘোরটোপের মধ্যে তৈরি করা। এর নিষ্ঠুর নিপীড়ন ক্রমাগতভাবে দেখানো হয় প্রশান্তভাবে খারাপের উপর ভালো’র এবং বিশৃঙ্খলার উপর শৃঙ্খলার বিজয় হিসাবে।

দেল্যুজ : হ্যাঁ এবং এর বিপরীতটাও একইভাবে সত্যি। শুধুমাত্র কয়েদীদেরকেই শিশু হিসাবে দেখা হয় না, আবার শিশুদেরকেও কয়েদী হিসাবে দেখা হয়। শিশুদেরকে একটা অপ্রাপ্তবয়স্কতার (
infantilization) মধ্যে ঢুকানো হয়, যা তাদের কাছে অপরিচিত। এর ভিত্তিতে এটা অস্বীকার করা সম্ভব না যে, স্কুলগুলি হাজতের মতোই এবং কারখানাগুলি হচ্ছে এর কাছাকাছি একটা ব্যাপার। রেনাল প্ল্যান্ট (Renault plant) এ ঢোকার দিকটা একবার দেখেন অথবা এইরকম যে কোনো জায়গাতেই: দিনে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য তিনটা টিকিট দেয়া হয়। আপনি আঠারোশ শতকে জেরেমি বেন্থামের (Jeremy Bentham) একটা লেখা পাবেন, হাজত-ব্যবস্থা সংস্কারের উপর; এই পদমর্যাদাসম্পন্ন সংস্কারের নামে প্রস্তাব করা হয় একটা বৃত্তাকার ব্যবস্থার, যেখানে পরিবর্তিত হাজতগুলি একটা মডেল হিসাবে কাজ করবে এবং যেখানে একজন আনুক্রমিকভাবে স্কুল থেকে কারখানায় যাবে, আবার কারখানা থেকে হাজতে যাবে, মানে এইভাবে চলতে থাকবে। এটা হচ্ছে সংস্কারের প্রণোদনা, প্রতিনিধিত্বের সংস্কারক । অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে, যখন মানুষ নিজের জন্যে কথা বলা এবং কাজ করা শুরু করে, তখন তারা তাদের প্রতিনিধিত্বটা অস্বীকার করে না (যদি তার বিপরীতও হয়) অন্যের কাছে; তারা একটা নতুন প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে না, ক্ষমতার একটা ভুয়া প্রতিনিধিত্ব করার চাইতে। উদাহারণস্বরূপ, আমি আপনার একটা কথা মনে করতে পারছি যে, বিচারের বিপরীতে কোনো জনপ্রিয় বিচার নাই (there is no popular justice against justice), এখানে বোঝাপড়াটা অন্য একটা লেভেলে।

ফুকো : আমি মনে করি না এই ধারণাটা এতোটা সরল যে, মানুষ আরো ভালো এবং ন্যায়সঙ্গত বিচারের রূপ প্রত্যাশা করে বিচারব্যাবস্থা, বিচারক, আদালত এবং হাজতে; বরং বাইরে থেকে এবং এসব কিছুর আগে, একটামাত্র উপলব্ধি আছে যে, ক্ষমতা সবসময় জনগণের মূল্যে ব্যবহার করা হয়। বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম তা হচ্ছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে একটা সংগ্রাম এবং আমি মনে করি না যে, এটা বিচার ব্যবস্থার অন্যায়ের বিরুদ্ধে বা এই সংস্থাগুলির কর্মদক্ষতা বাড়ানোর কোনো সংগ্রাম। বিশেষ করে, এটা খুব স্ট্রাইকিং যে, দাঙ্গা-হাঙ্গামার এবং বিপ্লবের সময় বা রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনগুলির সময় ক্ষমতার অনান্য সংস্থাগুলি যেমন অর্থনৈতিক সংগঠন বা সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিচার ব্যবস্থাকেও টার্গেট করা হয়। আমার হাইপোথিসিস-কিন্তু এটা একটা হাইপোথিসিস-ই-যে জনপ্রিয় আদালতগুলি, বিপ্লবের সময়গুলাতে যেটা দেখা যায়, নিন্ম মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের একটা উপায়, যারা জনগণের মিত্র হিসাবে থাকে, যারা উদ্ধার করে এবং পুনরায় দখল করে বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রচেষ্টাকে। এটা অর্জন করার জন্যে, তারা প্রস্তাব করে একটা আদালত ব্যবস্থার যেখানে ন্যায় বিচারের একটা সম্ভাবনা থাকে, যেখানে হয়ত রায় প্রদান করার একটা অভিনয় করা হয়। আদালতের আইনি ব্যবস্থার চিহ্নিত রূপটা আসলে বুর্জোয়া ভাবধারার ন্যায়ের মধ্যেই বিরাজ করে।

দেল্যুজ : আমাদের এই বাস্তব অবস্থার উপর ভিত্তি করে, ক্ষমতা প্রবলভাবে তৈরি করতে চায় একটা সম্পূর্ণ বা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি। তার মানে, বর্তমান সময়ের সমস্ত ধরনের অবদমন (অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি জাতিগত অবদমন, কারখানাগুলিতে অবদমন, শিক্ষা ব্যবস্থাগুলিতে এবং তরুণদের প্রতি সাধারণ অবদমন) খুব সহজেই সাধারণীকরণ করা সম্ভব ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের শুধুমাত্র ’৬৮ সালের মে’র প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে এই রূপগুলির ঐক্য খুঁজতে যাওয়াটা ঠিক হবে না, বরং এটা আরো মানানসই হবে নিকট ভবিষ্যতের পূর্ণপ্রস্তুতি নিতে এবং তা সংগঠিত করতে, ফরাসী পুঁজিবাদ এখন নির্ভর করতেছে “প্রান্তিক” বেকারত্বের উপর এবং লিবারাল ধারণাটা ত্যাগ করছে এবং পুরা কাজ দেয়ার জন্য ভালো স্বৈরাচারের মুখোশ পরছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আমরা সমস্ত ধরনের অবদমনের ঐক্যটা দেখা শুরু করতে পারি : অভিবাসীদের উপর বাধা-নিষেধ, যখন এটা স্বীকার করা হলো যে, সবচেয়ে কঠিন আর থ্যাংকলেস কজিগুলি করানো হয় অভিবাসী শ্রমিকদের দিয়ে-যা দিয়ে চলে কারখানাগুলির অবদমন, কারণ তা না হলে ফরাসীদের আবার শিখতে হবে, “স্বাদ” নিতে হবে ক্রমাগত কঠিন পরিশ্রম করার; তরুণদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় অবদমন চলে, কারণ পুলিশী ব্যবস্থায় অবদমন অনেক বেশি কার্যকর থাকে যখন সেইখানে নতুন লোকের দরকার কম পড়ে। একটা বিশাল সারির পেশাজীবীদের (শিক্ষক, মানসিক চিকিৎসক, সব ধরনের শিক্ষাবিদ, ইত্যাদি) বলা হয় সেই কাজগুলি করার জন্য যা সনাতনভাবে পুলিশদের করার কথা। এ কথা আপনি অনেকদিন আগে অনুমান করতে পারছিলেন, এবং সেই সময়ে এটা অসম্ভব বলে ভাবা হয়েছিল : কাঠামোর ভিতর সমস্ত রকমের অবরোধগুলিকে কাজে লাগানো। ক্ষমতার বৈশ্বিক নীতির বিপরীতে আমরা চালু করছি প্রতি-উত্তর, বিচ্ছিন্ন লড়াই, সক্রিয় এবং সময়ে সময়ে নিবৃত্তিমূলক প্রতিরক্ষা। আমাদের এমন সামগ্রিকতা তৈরি করার কোনো দরকার নাই যা ক্ষমতার দিক থেকে অপরিবর্তনীয়ভাবে সামগ্রিক করা আছে; আমাদের যদি একই পথে যেতে হয়, তাহলে তা কেন্দ্রিকতার রূপের মতোই হবে এবং সেই একই পুরোহিত ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করবে। আমাদের অবশ্যই পার্শ্বিক সম্বন্ধ তৈরি করতে হবে এবং নেটওয়ার্কের একটা সম্পূর্ণ শৃঙ্খলা দাঁড় করাতে হবে এবং তা জনপ্রিয় ভিতগুলির উপর; আর এটা বিশেষভাবে কঠিন। কোনোভাবেই আমরা আর বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে পারি না প্রতিযোগিতার প্রথাগত ধারণার ভিতর একটা অবিরাম রাজনৈতিক ঘটনা হিসাবে এবং কমিউনিস্ট পার্টি বা জেনারেল ওর্য়াকার্স ইউনিয়ন(৬) এর প্রতিনিধিত্বকারীদের ক্ষমতার বিপনেন ভিতর। বাস্তবতা হচ্ছে যা সত্যিকারের অর্থে ঘটছে কারখানাগুলিতে, স্কুলগুলিতে, ব্যারাকগুলিতে, হাজতখানাতে আর পুলিশ ফাঁড়িগুলিতে। এই কাজগুলি অন্য ধরনের তথ্য নিয়া আসে সংবাদপত্রগুলিতে যা পাওয়া যায় না, তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু (এটা ব্যাখ্যা করে
Agence de Press Liberation (৭) কী ধরণের তথ্য বহন করে)।

ফুকো: সংগ্রাম করার জন্য প্রয়োজনীয় পথগুলি আবিষ্কার করাটা কি কঠিন না, এই কারণে যে, আমরা ক্রমাগতভাবে এড়িয়ে চলছি ক্ষমতার সমস্যাটাকে? শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হয়েছে উনিশ শতক পর্যন্ত, শোষণের প্রকৃতি বোঝার আগ পর্যন্ত, এবং আজ পর্যন্ত আমাদের এখনো বোঝার বাকি আছে ক্ষমতার সব মিত্রশক্তিগুলিকে। হয়তো মার্কস এবং ফ্রয়েড আমাদের বোঝার ইচ্ছাটাকে পুরাপুরি সন্তুষ্ট করতে পারেন নাই, যেই বিভ্রান্তিকর জিনিসটাকে আমরা ক্ষমতা বলি, যা একইসাথে দৃশ্যমান আবার অদৃশ্য, চোখের সামনে আবার আড়ালে লুকানো, সর্বব্যাপী। সরকার সম্পর্কে তথ্যগুলি এবং তাদের নির্মাণকৌশলগুলির সনাতন বিশ্লেষণগুলি অবশ্যই সবক্ষেত্রগুলির কথা বলতে পারে না যে, কোথায় ক্ষমতার ব্যবহার করা হয় এবং কোথায় এটা কাজ করে? ক্ষমতার প্রশ্নটা থাকে একটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তি হিসাবে। কে ক্ষমতার ব্যবহার করে? এবং কোন ক্ষেত্রে তা করে? আমরা এখন অবশ্যই যুক্তিপূর্ণভাবে জানি কে অন্যদেরকে শোষণ করে, কে মুনাফাগুলি পায়, কোন কোন লোক এর সাথে জড়িত এবং আমরা জানি কীভাবে এইসব ফান্ডগুলি পুনরায় বিনিয়োগ করা হয়। কিন্তু ক্ষমতার ক্ষেত্রে . . . আমরা জানি যে, এটা তারা না যারা শাসন করে। কিন্তু, অবশ্যই “শাসকশ্রেণী”র ধারণাটা কখনোই যথেষ্ঠভাবে সূত্রবদ্ধ করা হয় নাই এবং অনান্য টার্মগুলিও, যেমন “কর্তৃত্ব খাটানো” . . . “বিচার করা” . . . “শাসন করা”, ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি খুবই তরল এবং এদের বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমাদের আরো তদন্ত করা প্রয়োজন ক্ষমতার ব্যবহারের আরোপিত সীমাবদ্ধতাগুলি-যে রিলে পথের মধ্যে দিয়া সে ক্রিয়াশীল থাকে এবং মাঝে মাঝে তার প্রভাবের সীমানা ক্ষমতাক্রমের খুব অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলীর মধ্যেও এবং নিয়ন্ত্রণ, নজরদারী, নিষিদ্ধকরণ এবং বাধাগুলির রূপের মধ্যে। সবখানে, যেখানে ক্ষমতা বিরাজ করে, তার ব্যবহার করা হয়। কঠোরভাবে বলতে গেলে, ক্ষমতার অফিসিয়াল অধিকার কারোরই নাই; তারপরও এটাকে সবসময় সক্রিয় করা হয় একটা নির্দিষ্ট দিকে; কিছু লোককে একদিকে রেখে আবার কিছু লোককে অন্যদিকে রেখে। মাঝে মাঝে এটা যথাযথভাবে বলা মুশকিল যে, কে ক্ষমতাবান, কিন্তু এটা দেখা সহজ যে, কার ক্ষমতা নাই। যদি আপনার বইটা পড়া আমার জন্য প্রয়োজনীয় মনে হয় (অ্যান্টি-অডিপাস৮) সেটা এই কারণে যে, তারা এই সমস্যাটাকে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে পারে : প্রাচীন অর্থের মানের ভিতর, চিহ্নিতকারী এবং চিহ্নিতের ভিতর, ইত্যাদি; আপনি ক্ষমতার প্রশ্নটাকে ক্ষমতার অসাম্যতাটাকে এবং তাদের সংগ্রামগুলিকে তৈরি করেছেন। প্রত্যেকটা সংগ্রাম একটা বিশেষ ধরনের উৎসকে ভরাট করছে (অসংখ্যের মধ্যে যে কোনো একটাকে, ছোট্ট উৎসগুলি-স্বল্প সময়ের বস, “এইচ.এল.এম.” এর ম্যানেজার, একজন কারারক্ষক, একজন বিচারক, একজন ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্বকারী, সংবাদপত্রের এডিটর-ইন-চিফ)। আর উৎসগুলিকে নির্দিষ্ট করা-অভিযুক্ত করা এবং বলা-যদি সংগ্রামের একটা অংশ হয়ে থাকে, এর কারণ এটা না যে আগে কেউ জানতো না। বরং এই বিষয়ে এটা বলার কারণ, তথ্যের নেটওর্য়াকের সংস্থাগুলিকে শুনতে বাধ্য করা, নামগুলি বলা, দোষীদের দিকে আঙুল তোলা, টার্গেটগুলিকে খুঁজে বের করা; ক্ষমতার বিপরীতে প্রথম পদক্ষেপ এবং ক্ষমতার বর্তমান রূপগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামের দীক্ষা। যদি কারাগারে বসবাসকারীরা বা হাজতীদের ডাক্তারদের ডিসকোর্স নতুন ধরনের সংগ্রামের সূচনা করে, এর কারণ তারা বাজেয়াপ্ত করে, খুব অস্থায়ীভাবে হলেও তারা ক্ষমতাবান হাজতের পরিস্থিতি সর্ম্পকে বলার জন্য-বর্তমানে হাজতের প্রশাসনিক ব্যবস্থাগুলির একচেটিয়া সম্পত্তির উপর এবং সংস্কার গ্র“পগুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে। সংগ্রামের ডিসকোর্সটা অজ্ঞানতার বিপক্ষে না, বরং গোপনীয়তার বিরুদ্ধে। এটাকে একইরকম মনে হতে পারে; কিন্তু আমরা যা ধারণা করি, যদি তার চাইতে বেশি কিছু হয়? ভুলবোঝাবুঝির একটা পুরা ক্রম এই বিষয়গুলার সাথে জড়িত, যারা “সুযোগ-সন্ধানী” “অবদমিত” এবং “বলতে-না-পারা” এবং তার অনুমতি দেয় সস্তা “মনোসমীক্ষণ”কে সংগ্রামের সঠিক অবজেক্টগুলিকে ব্যাখ্যা করার জন্য। সম্ভবত এটা অপেক্ষাকৃত কঠিন, একটা অচেতন বিষয়ের চাইতে একটা গোপনীয় বিষয়কে উদঘাটন করা। সম্প্রতি দুইটা বিষয়ই ক্রমাগতভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে যে, “লেখালেখি অবদমিত বিষয়গুলাকে তুলে ধরে” এবং আরেকটা বিষয় হচ্ছে “লেখালেখি অবশ্যই একটা নাশকতা মূলক কাজ” যা মনে হচ্ছে প্রতারণামূলক যা অনেক ক্রিয়ার ভিতর অনেকবারই অভিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতা পাচ্ছে।

দেল্যুজ : আপনি যে সমস্যাটা উত্থাপন করলেন, তার প্রতি সম্মান রেখে বলছি : এটা খুব স্পষ্ট যে, কে শোষণ করে, কে মুনাফা বানায়, এবং কে শাসন করে, কিন্তু এইসব কিছুর পরেও ক্ষমতা এমন একটা কিছু যা সবদিকে ছড়িয়ে আছে। আমি একটা হাইপোথিসিস বলার ঝুঁকি নিবো : মার্কসিজম-এর প্রচেষ্টাটা ছিল স্বার্থের দিক দিয়ে আবশ্যিকভাবে বিবেচনা করে সমস্যাটাকে সংজ্ঞায়িত করা (শাসকশ্রেণী নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখে)। যে প্রশ্নটা সাথে সাথে আসে : যাদের স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না তারা কীভাবে বিরাজমান ক্ষমতা-ব্যবস্থাটাকে সমর্থন করবে, তাদের অংশের একটা কাজের দাবির মাধ্যমে? সম্ভবত এর কারণ বিনিয়োগের দিক থেকে, অর্থনৈতিক বা অচেতন যে কোনোভাবেই, স্বার্থটাই শেষ উত্তর না; এখানে বাসনার বিনিয়োগও আছে, যার ভূমিকা আরো বেশি গভীর এবং পরিব্যাপ্ত, আমাদের স্বার্থ যা নির্দেশ করে, তার চাইতে। কিন্তু অবশ্যই, আমরা ইচ্ছাকে স্বার্থের বিপরীতে দাঁড় করাই না, কারণ স্বার্থ সবসময় অনুসরণ করে এবং নিজেকে খুঁজে পায় যেখানে তার বাসনা আছে। আমরা চিৎকার করে রাইখ (
Reich) বন্ধ করে দিতে পারি না: জনগণ বিভ্রান্ত না; একটা নির্দিষ্ট সময়ে তারা ফ্যাস্টিট শাসন চাইছিলো! ইচ্ছার একটা ভূমিকা আছে যা ক্ষমতার ছাঁচ তৈরি করে এবং তার বিপনন করে, এটাকে একজন পুলিশের জন্য যেমন সম্পত্তিতে পরিণত করে যেমন করে একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্যেও; এই প্রেক্ষিতে, পুলিশের বা প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহৃত ক্ষমতার মধ্যে কোনো গুণগত পার্থক্য নাই। একটা সামাজিক গ্র“পের ভিতর বাসনার এইসব প্রকৃতিগত বিনিয়োগগুলি ব্যাখ্যা করতে পারে শ্রেণীস্বার্থের কারণে রাজনৈতিক দলগুলি বা ইউনিয়নগুলি কী কারণে বিপ্লবী বিনিয়োগগুলি করে বা করতে পারে, যা বেশিরভাগ সময়ই সংস্কারমুখী বা পুরাপুরি প্রতিক্রিয়াশীল ইচ্ছার দিক থেকে।

ফুকো : আপনি যেমনটা বলেছেন যে, বাসনা, ক্ষমতা এবং স্বার্থের সম্পর্কটা অনেক বেশি জটিল আমরা স্বাভাবিকভাবে যা চিন্তা করি তার চাইতে, কিন্তু আবশ্যিকভাবে তাদের জন্য না যারা ক্ষমতার ব্যবহার করে, যাদের এটা সম্পাদন করার স্বার্থ থাকে; কিংবা তাদের জন্য যারা ক্ষমতা ব্যবহার করার জন্য স্বার্থ দান করে। তাছাড়া, ক্ষমতার ইচ্ছা, ক্ষমতা এবং স্বার্থের মধ্যে একটা অনন্য সর্ম্পক স্থাপন করে। ফ্যাস্টিট পিরিয়ডের সময় এটা হতে পারে যে, জনগণ চাইছিলো কিছু লোকের কাছে ক্ষমতা যাক, সেই লোকগুলিকে তারা চিনতে পারে নাই, যারা জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার প্রয়োগ করেছিলো এবং তাদেরকে নিজেদের বিনিময়ে এর মূল্য দিতে হয়েছে, তাদের মৃত্যুর বিনিময়ে, তাদের বিসর্জনের মাধ্যমে, তাদের গণহত্যার মাধ্যমে। তা সত্ত্বেও, তারা এই বিশেষ ক্ষমতাটা চাইছিলো; তারা চাইছিলো যে, এটা ব্যবহৃত হোক। বাসনা (
desire) , ক্ষমতা এবং স্বার্থ-এর এই খেলাটা খুব একটা মনোযোগ পায় নাই। শোষণের বিষয়টা বুঝতে আমাদের অনেক সময় লেগেছিল; এবং ইচ্ছার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার এবং এরও দীর্ঘ একটা ইতিহাস আছে। এটা সম্ভব যে সংগ্রামগুলি চলছে এবং স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বিচ্ছিন্ন তত্ত্বগুলি এই সংগ্রামগুলি থেকে উদ্ভূত হচ্ছে, এবং যা তাদের অবস্থানের থেকে অবিচ্ছিন্ন এবং আমাদের আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে যার ভিতর ক্ষমতার চর্চা হয়।

দেল্যুজ : এই জায়গাটাতে এসে আমি আবার সেই প্রশ্নটাতে ফেরত যেতে চাই : বর্তমান সময়ের বিপ্লবী আন্দোলনগুলি বহুবিধ কেন্দ্র সৃষ্টি করছে এবং দুর্বলতা বা অপর্যাপ্ততার জন্যে না, যেহেতু একটা বিশেষ ধরনের সামগ্রিকতার ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিক্রিয়ার জন্যে বাধ্য করছে। (দৃষ্টান্তস্বরূপ, স্থানীয় প্রতি-কৌশল হিসাবে ভিয়েতনাম একটা ভালো উদাহরণ)। কিন্তু আমরা কী করে নেটওর্য়াকগুলিকে সংজ্ঞায়িত করব, এইসব সক্রিয় এবং বিচ্ছিন্ন জায়গাগুলাকে, একটা দেশ থেকে আরেকটা দেশে অথবা একটা দেশের ভিতর?

ফুকো : আপনি ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার যে প্রশ্নটা তুলছেন, তা হয়তো এই অর্থটা বোঝায় : যখন আমরা শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করি, প্রলেতারিয়েতরা শুধুমাত্র সংগ্রামের নেতৃত্বই দেয় না বরং টার্গেটগুলিকেও ঠিক করে, তার পদ্ধতিগুলিকেও, জায়গাগুলিকে এবং সংঘর্ষের হাতিয়ারগুলিকে; এবং নিজেকে প্রলেতারিয়েতদের সাথে যুক্ত করার মানে তার অবস্থানগুলিকে, তাদের আদর্শকে এবং যুদ্ধ করার প্রবৃত্তিগুলিকে স্বীকার করা। তার মানে সম্পূর্ণ একটা চিহ্নিতকরণ। কিন্তু এই যুদ্ধটা যখন ক্ষমতার বিরুদ্ধে চালিত করা হয়, তখন যাদের উপর ক্ষমতার প্রয়োগ করা হয়েছিল তাদের ক্ষতির জন্যে, যারা এটাকে দুর্বিষহ মনে করবে, তারা নিজেদের ভূখন্ডে এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করতে পারে, তাদের নিজস্ব কাজ-কর্মের মাধ্যমে (অথবা তাদের নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে)। একটা সংগ্রামে জড়িত হওয়া যেখানে তাদের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত, যার উদ্দেশ্যগুলি স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে এবং যার পদ্ধতিগুলি তারা নিজেরা ঠিক করতে পারছে, তখন তারা একটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করছে। তারা স্বাভাবিকভাবেই নিজেরা প্রলেতারিয়েতদের মিত্র হয়ে যাচ্ছে; কেননা ক্ষমতা ব্যবহার করা হয় এমন একটা ভাবে যেখানে পুঁজিবাদী শোষণ বজায় রাখা হয়। তারা সত্যিকারভাবে প্রলেতারিয়েতদের কারণকে সমর্থন করে এসব জায়গাগুলিতে যুদ্ধ করার মাধ্যমে, যেখানে তারা নিজেদেরকে শোষিত হিসাবে দেখতে পায়। নারী, হাজতীরা, জোর করে সেনাবাহিনীতে নেয়া সৈন্যরা, হাসপাতালের রোগীরা এবং সমকামীরা এখন একটা বিশেষ ধরণের সংগ্রাম শুরু করছে ক্ষমতার বিশেষায়িত দিকটার বিপরীতে, যে বাধাগুলি এবং নিয়ন্ত্রণগুলি তাদের উপর চাপানো হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। এই ধরনের সংগ্রামগুলি আসলে বিপ্লবী আন্দোলনগুলির সাথে জড়িত, যেদিক থেকে তারা মৌলিক, আপোসহীন এবং অ-সংস্কারমুখী, এবং একই ক্ষমতার নতুন কোনো বিন্যাসের চেষ্টাকে তারা অস্বীকার করে, অন্তত, প্রভুর পরিবর্তনকেও। আর এই আন্দোলনগুলি প্রলেতারিয়েতদের বিপ্লবী আন্দোলনগুলির সাথে সম্পর্কিত যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণগুলির এবং সীমাবদ্ধতাগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যা ক্ষমতার একই ব্যবস্থাকে সেবা করে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সংগ্রামটার যে পুরা চিত্র আমরা পাই, সেটা আপনি প্রথমে যে টোটালাইজেশন-এর কথা বলেছিলেন তা না, এই তাত্ত্বিক টোটালাইজেশনটা তৈরি হচ্ছে একটা “সত্য”-এর ভানের ভিতর। সংগ্রামটার সাধারণ রূপটা বিশেষভাবে বের হয়ে আসছে ক্ষমতা ব্যবস্থার নিজের ভিতর থেকে, ক্ষমতা যেখানে ব্যবহার করা হয় এবং প্রয়োগ করা হয় তার সমস্ত রূপ থেকে।

দেল্যুজ : আর এখানে এসে আমরা কোনো ধরনের প্রয়োগই করতে পারি না তার বিস্তৃত চরিত্রটাকে উন্মোচন না করে, যাতে আমরা অপরিহার্যভাবে নেতৃত্ব দিতে পারি-সবচেয়ে তাৎপর্যহীন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতেও - তার ইচ্ছাটাকে সম্পূর্ণভাবে উপড়ে ফেলতে পারি। প্রত্যেকটা বিপ্লবী আক্রমণ অথবা প্রতিরক্ষা, আংশিকভাবে হলেও, এইভাবে, শ্রমিকদের সংগ্রামের সাথে যুক্ত।




পাদটীকা:

১.
"Groupe d'information de prisons": ফুকোর সাম্প্রতিক সময়ের দুইটা পাবলিকেশন (I, Pierre Riviere and Surveiller et Punir) এই সঙ্গ থেকে এসেছে।
২. উপরের বইয়ের-ই কথা; পৃষ্টা ১৮৫.
৩. মে ১৯৬৮, “মে মাসের ঘটনাবলী” হিসাবে খ্যাত।
৪.
L'Ordre du discours তে দেখুন, পৃষ্টা. ৪৭-৫৩.
৫. রেনে প্লেভেন (
Rene Pleven) ১৯৫০ এর প্রথম দিকে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
৬.
"Confederation Generale de Travailleurs."
৭. লিবারেশন নিউজ এজেন্সী ।
৮.
Nietzsche et la Philosophie (Paris: P.U.F., ১৯৬২) and Capitalisme et schizophrenie, ভলিউম.১, অ্যান্টি-অডিপাস ফেলিক্স গুট্টেরীর সাথে সহলেখক হিসাবে প্রকাশিত (Paris: Editions de Minuit, ১৯১২).
৯.
à Loyer Modéré এর বাসস্থান - মোটামুটি দামের ভাড়া বাসা।

________________________________________________________

বাংলা অনুবাদের নোট:


ইংরেজী ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ শব্দটার বাংলা ‘বুদ্ধিজীবি’ বলতে আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, বলা যায় সঠিক বলেও মনে হয় না। কারণ এতে পেশার একটা ব্যাপার আবিশ্যিকভাবে ধরে নেয়া হয়, শব্দটার ভিতর, যা সবসময় একই ঘটনা বলে আমার মনে হয় না, বরং এর সাথে চর্চার একটা ব্যাপার বেশি জড়িত বলে আমার ধারণা। এইক্ষেত্রে ‘বুদ্ধিজীবি’ শব্দটাকে এড়াতে গিয়াই বুদ্ধিচর্চাকারী, তবে ‘ইন্টেলেক’ বিষয়টাকে শুধুমাত্র ‘বুদ্ধি’ দিয়া সীমিত করা হৈছে কিনা, সেই প্রশ্নটাও আছে। আমার ধারণা, ‘বুদ্ধিচর্চাকারী’র চাইতেও ভালো বাংলা হওয়া সম্ভব।

যখনই তত্ত্ব এর প্রসঙ্গ আসে, তখনই প্রশ্ন আসে যে, কে তত্ত্ব প্রণয়ন করেন আর যিনি করেন তিনি কি একজন বুদ্ধিচর্চাকারী? একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর দায়িত্বটা কি? সে কি জনগণের পক্ষে সত্য কথা প্রচার বা জানাবে যে, ‘সত্য’ কি? ফুকো এবং দেল্যুজ দুইজনেই একমত যে, বুদ্ধিচর্চাকারীর সেই ভূমিকাটা নিবার কোন দরকার নাই, কারণ তারা নিজেরাই হয়া উঠতে পারেন বা হয়া উঠছেন ‘ক্ষমতার এক একজন এজেন্ট’। বরং একজন বুদ্ধিচর্চাকারীর ভূমিকা হচ্ছে ক্ষমতার গোপন জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করা, যেখানে সে অপারেট করে এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে প্রতিষ্ঠা করে। সেইক্ষেত্রে একা তত্ত্ব কোন অর্থই তৈরি করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তা, বাস্তবে ব্যবহারযোগ্য হিসাবে আর্বিভুত হচ্ছে।

তাদের চিন্তার মিল যেমন আছে, তেমনি অমিলটাও অস্পষ্ট না। দেল্যুজ যারে বলতে চাইতেছেন ডিজায়ার বা বাসনা, ফুকো তারে বলতে চান, প্লেজার বা আনন্দ বলে। যেমন, ক্ষমতার একটা আনন্দ আছে। আবার দেল্যুজ এর ডিজায়ার কোন রেটরিক জিনিস না। লাঁকা এবং দেল্যুজের ‘ডিজায়ার’ও একই জিনিস না। লাঁকা যেখানে ডিজায়ারকে আবিষ্কার করেন, একটা ঘাটতি হিসাবে সেখানে দেল্যুজ তারে দেখতে চান একটা প্রক্রিয়া হিসাবে। ফুকো’র কথামতো মনে হয় যে, তিনি আসলে দেল্যুজের ‘ডিজায়ার’কে ‘প্লেজার’ দিয়া পরিবর্তিত করতে চান। কিন্তু ফুকোর বিশ্লেষণে ক্ষমতা যেমন একটা কেন্দ্রীয় মনোযোগ একইভাবে দেল্যুজের ক্ষেত্রে সেই বিষয়টা সম্ভবত মানুষ একটা ডিজায়ার মেশিন হিসাবে। মানে, এই নিয়া আসলে আরো অনেক আলাপ আছে!

আমার ধারণা, আমাদের দেশে অনেকেই ফরাসী দার্শনিকদেরকে চিন্তার কোট করেন; কিন্তু তাদের লেখাপত্র সাধারণের আওতায় নিয়া আসার কোন কোশিশ করেন না, কেন করেন না সেইটা আমার কাছে মাঝে মাঝে আজবই লাগে। কারো মতো কৈরা কথা বলার চাইতে বা কারো কথা কোট করার চাইতে তার কথাটারে বৈলা দেয়াই তো ভালো; বরং এর থিকা নতুন কোনো চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত হৈতে পারে। আর ফুকো এবং দেল্যুজ এর এই কথা-বার্তা সেই নতুন চিন্তা-ভাবনার জন্য একটা ভালো উপাদান।

ফুকো এবং দেল্যুজ এর মধ্যে এই কথা-বার্তাগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হৈছে আমার কাছে, এই কারণে যে, এই কথা-বার্তাটা কিছু বিষয়কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে এবং প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়া সামনে আগানোর পথগুলিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন; যেখানে, তত্ত্বচিন্তা ও প্রায়োগিকতার সর্ম্পকটাকে তার ব্যাখ্যা করেন এবং তাদের স্বরূপ ও সর্ম্পকটাকে নতুন জায়গায় নিয়া আসেন।

এই আলাপচারিতা সম্পর্কে বলা যায়, ফুকো এবং দেল্যুজ দুইজনে ঘনিষ্ঠ লোক ছিলেন, একসাথে বেশ কিছু কাজও করছেন। দ্জুনেই বলা যায় ছিলেন, অ্যাকাডেমিক গুরু। দেল্যুজের একটা বইয়ের উপর আলোচনা লিখতে গিয়া ফুকো বলছিলেন যে, ‘হয়তো একদিন এই শতাব্দীকে বলা হবে দেল্যুজিয়ান শতাব্দী।’ এই সার্টিফিকেট এর উল্লেখ মোটামুটি দেল্যুজের সব বইয়ের পিছনেই দেয়া থাকে। আর ১৯৮৪ সালে ফুকো মারা যাওয়ার পর দেল্যুজ তার উপর একটা বই লেখেন এবং দেল্যুজ বিভিন্ন জায়গায় ফুকোর বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছেন।

এই আলাপটা রেকর্ড করা হয় ১৯৭২ সালের ৪ঠা মার্চ; এবং এটা ছাপা হয় লার্ক-এর (খ'অৎপ) ৪৯ নম্বর সংখ্যায়, পৃষ্ঠা ৩-১০; যে সংখ্যটা করা হৈছিল দেল্যুজের উপর। লিখাটা লার্ক-এর পারমিশন নিয়া রিপ্রিন্ট করা হয় ইন্টারঅ্যাক্টিভিস্ট নামে একটা ওয়েব সাইটে (যঃঃঢ়://রহভড়.রহঃবৎধপঃরারংঃ.হবঃ/ধহধষুংরং/০৩/০১/১৩/০০৫৬২০০.ংযঃসষ)। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে সেই ইংরেজীটাই নেয়া হৈছে। এর ফুটনোটগুলি লার্ক-এর সম্পাদকের দেয়া।

বাংলা অনুবাদটা প্রথম প্রচারিত হয় কবিসভা নামে একটা ওয়েব গ্র“পে, সম্ভবত ২০০৬ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে এবং দৈনিক সমকালের সাহিত্য পাতা কালের খেয়াতে ছাপা হয় ২০০৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে।

No comments: